বন্ধুরা, আমাদের জীবন এমন এক প্রহেলিকা যেখানে শ্রম ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আজকের সমাজে অনেকেই শ্রমকে অবহেলা করে, তার যথাযথ মূল্য দেয় না। অথচ আমাদের উপনিষদগুলিতে বারবার বলা হয়েছে—”শ্রমই প্রকৃত উপাসনা”। তাই আজ আমি তোমাদের নিয়ে যাব উপনিষদের গভীরে, যেখানে আমরা শ্রমের প্রকৃত মূল্য ও তার সম্মানের উপদেশ খুঁজে পাব।
শ্রমের গুরুত্ব: উপনিষদের আলোকে
উপনিষদের মূল শিক্ষাগুলির মধ্যে একটি হলো কর্ম এবং তার ফল। আমাদের জীবনে শ্রম বা পরিশ্রম ছাড়া সফলতা অসম্ভব। উপনিষদে বলা হয়েছে:
“ন হি কশ্চিত্ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃত্।”
(ভগবদ গীতা ৩.৫—যদিও এটি গীতার, কিন্তু উপনিষদের শিক্ষারই প্রতিফলন)
অর্থাৎ, এই পৃথিবীতে কেউই এক মুহূর্ত কর্ম বা শ্রম ছাড়া থাকতে পারে না।
আমাদের নিজেদের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, কেন এত শ্রম করব? শ্রমের উদ্দেশ্য কী?
উত্তর একটাই—শ্রম আমাদের জীবনের গতি দেয়, আত্ম-পরিচয় গড়ে তোলে। যেমন নদীর জল সারাক্ষণ বইতে থাকে, তেমনি আমাদেরও শ্রমের মাধ্যমে জীবনের প্রবাহমানতা বজায় রাখতে হবে।
প্রকৃত উদাহরণ: কৃষকের শ্রম এবং উপনিষদের উপদেশ
একবার ভাবো, এক কৃষক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমিতে পরিশ্রম করে। সূর্যের প্রখর তাপে সে জমি চাষ করে, শস্য ফলায়। এই শ্রমের পিছনে তার একটাই আশা—পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়া। কৃষকের শ্রমকে যদি সম্মান না দেওয়া হয়, তাহলে সেই শস্যের মূল্য কোথায়?
উপনিষদে বলা হয়েছে:
“যথা কর্মণ্যথা ফলম্।”
(শ্রীরূপনিষদ)
অর্থাৎ, যেভাবে তুমি কর্ম করবে, ঠিক সেই অনুযায়ী ফল পাবে।
এখানে কৃষকের উদাহরণটি আমাদের শেখায়—শ্রমের মধ্যেই প্রকৃত সাফল্যের বীজ রয়েছে। কোনো কাজ ছোট নয়। সমাজে সবাই যদি নিজের নিজস্ব শ্রমকে সম্মানের চোখে দেখে, তাহলে পৃথিবী আরো সুন্দর হবে।
শ্রম ও আত্মা: একটি গভীর উপলব্ধি
বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে:
“অত্মনৈব আত্মানং পশ্যৎ।”
অর্থাৎ, নিজের শ্রম ও কর্মের মাধ্যমেই তুমি নিজেকে চিনতে পারবে।
এখানে শ্রমের একটি আধ্যাত্মিক দিক প্রকাশ পায়। তুমি যখন মন দিয়ে, নিষ্ঠার সাথে শ্রম করো, তখন তা শুধু বাহ্যিক কাজ নয়, তা এক প্রকার আত্মার সাধনা। প্রতিটি শ্রমই তোমাকে তোমার সত্যিকার আত্মার দিকে নিয়ে যায়। যেমন:
- একজন শিল্পী তার শিল্পের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়।
- একজন লেখক লেখার মাধ্যমে নিজের উপলব্ধি প্রকাশ করে।
- একজন শিক্ষক পরিশ্রমের মাধ্যমে ছাত্রদের জীবনে আলো এনে দেয়।
এই প্রত্যেকটি উদাহরণে দেখা যায়—শ্রম শুধু বাহ্যিক কর্ম নয়, এটি আত্মার অভিব্যক্তি।
নিজের কর্মকে ছোট ভেবো না: শ্লোকের শক্তি
অনেক সময় আমরা নিজেদের কাজকে ছোট করে দেখি। ভাবি, হয়তো অন্য কেউ বেশি সম্মানের যোগ্য। কিন্তু উপনিষদ আমাদের শেখায়:
“তৎ ত্বমসি।”
(ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.৮.৭)
অর্থাৎ, তুমিই সেই মহান সত্তা।
তোমার কাজ যত ছোট হোক না কেন, তা কখনোই তুচ্ছ নয়। মনে রেখো, মহৎ কাজের শুরু হয় ছোট কাজের মাধ্যমেই।
একবার এক কাঠুরের গল্প শুনেছিলাম। সে প্রতিদিন পরিশ্রম করে কাঠ কাটত এবং তা বিক্রি করে সংসার চালাত। কেউ তার কাজকে তুচ্ছ ভাবত, কিন্তু একদিন সেই কাঠুরের সংগ্রামের কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে। তার শ্রম এবং সৎ জীবনযাপন সমাজের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়।
শ্রমের সম্মান: সমাজে পরিবর্তনের চাবিকাঠি
আজকের সমাজে শ্রমের সম্মান প্রায় ভুলতে বসেছে অনেকে। কিন্তু উপনিষদের শিক্ষা আমাদের স্মরণ করায়:
“কর্মণ্যেবাদিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
(ভগবদ গীতা ২.৪৭)
এটি আমাদের বলে, শ্রম করো, কিন্তু ফলের আশা করো না। ফল আসবেই, কিন্তু তোমার শ্রমই সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
এই উপলব্ধি সমাজের জন্য কতটা জরুরি? ধরো, একজন স্বাস্থ্যকর্মী রাতদিন পরিশ্রম করছে মানুষের সেবায়। আমরা যদি তার শ্রমকে সম্মান না দিই, তাহলে কি সমাজ এগিয়ে যাবে?
শ্রমের প্রকৃত মূল্য ও সম্মানই সমাজকে গঠন করে।
উপনিষদের বার্তা: প্রত্যেক শ্রমের পেছনে ঈশ্বরের স্পর্শ
আমরা যখন মন দিয়ে পরিশ্রম করি, তখন সেটা শুধুই একটা কাজ থাকে না, সেটা হয়ে ওঠে উপাসনা। ঈশ্বর আমাদের শ্রমের মধ্যে বিরাজ করেন। যেমন—
- একজন মাতা যখন সন্তানের জন্য রাত জেগে কাজ করেন, সেই শ্রমে ঈশ্বরের আশীর্বাদ রয়েছে।
- একজন কর্মী যখন তার দায়িত্ব পালন করেন, তার কাজও ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়ে যায়।
ঈশা উপনিষদে বলা হয়েছে:
“ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত।”
অর্থাৎ, এই পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি কর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে।
কীভাবে আমরা শ্রমকে সম্মানিত করব?
বন্ধুরা, শ্রমের সম্মান দিতে হলে আমাদের প্রথমে নিজের কাজকে ভালোবাসতে হবে। নিজের পরিশ্রমকে তুচ্ছ ভাবলে চলবে না। মনে রেখো:
“শ্রমই শক্তি, শ্রমই সাফল্যের চাবিকাঠি।”
তাহলে এখন আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন করি—তুমি কি তোমার নিজের শ্রমকে যথেষ্ট সম্মান দাও? নাকি এখনও নিজের কর্মকে ছোট ভাবছো?
উপনিষদের শিক্ষা আমাদের শেখায়—প্রত্যেক শ্রমেই রয়েছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সুতরাং, আজ থেকে শুরু হোক আমাদের নতুন যাত্রা—নিজের এবং অন্যের শ্রমকে যথাযথ সম্মান জানিয়ে জীবনকে আরো সুন্দর করে তোলা।
“তোমার কর্মই তোমার পরিচয়। তাই মন দিয়ে শ্রম করো, কারণ শ্রমেই জীবনের আসল সৌন্দর্য।”