অর্থনীতির ক্ষেত্রে সততা ও ন্যায়বিচার কীভাবে বজায় রাখা যায়?

অর্থনীতির ক্ষেত্রে সততা ও ন্যায়বিচার কীভাবে বজায় রাখা যায়?

আমরা প্রতিদিন অর্থনীতির চাকা ঘোরাই—কেউ চাকরি করি, কেউ ব্যবসা করি, আবার কেউ বড় বড় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু একটা বিষয় প্রায়ই অবহেলিত থেকে যায়, তা হলো সততা আর ন্যায়বিচার। অর্থের প্রতি লোভ আর স্বার্থপরতার জাল আমাদের এমনভাবে জড়িয়ে ফেলে যে কখনও কখনও আমরা ভুলে যাই আমাদের মানবিক দায়িত্বের কথা। কিন্তু উপনিষদের শিক্ষা এ বিষয়ে আমাদের চোখ খুলে দেয়।

“সত্যমেব জয়তে”—এই বিখ্যাত বাক্যটি মুন্ডক উপনিষদ থেকে নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো, সত্যই শেষমেশ জয়ী হয়। তাই অর্থনীতিতে যদি তুমি সত্য ও ন্যায়বিচার বজায় রাখতে পারো, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে তুমি অবশ্যই সফল হবে। আসো, আজ আমরা উপনিষদের আলোকে আলোচনা করি কীভাবে জীবনের প্রতিটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপে সততা ও ন্যায়বিচার বজায় রাখা যায়।

১. অর্থের উৎস এবং প্রকৃতি: উপনিষদের শিক্ষা

ঐশ উপনিষদ আমাদের শেখায়—
“ঐশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।”*
অর্থ: এই জগতে যা কিছু আছে, সবই পরমাত্মার দ্বারা পরিব্যাপ্ত।

এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে অর্থ, সম্পদ—সবই ঈশ্বরের দান। অর্থের মালিকানা নিয়ে অহংকার করা অর্থহীন। যদি তুমি জানো যে এই পৃথিবীর সব কিছুই পরমাত্মার অংশ, তাহলে অর্থনৈতিক লোভ কমে যাবে।

একজন ব্যবসায়ী যখন জানেন যে তার অর্জিত অর্থ সৃষ্টির সেবা করার জন্য, তখন তিনি অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করবেন না। আমি নিজেও এক সময় ভুল পথে লাভের চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু এই শ্লোকের গভীর অর্থ উপলব্ধি করার পর, আমি অর্থকে ধর্মের পথে ব্যবহারের শপথ নিই।

২. “সত্যমেব জয়তে”: সততার অনুশীলন

উপনিষদে বলা হয়েছে—
“সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ”*
অর্থ: সত্যের পথেই দেবলোকের (অর্থাৎ সর্বোচ্চ সুখের) দিকে যাওয়া সম্ভব।

আমাদের জীবনে সততার মূল্য অপরিসীম। সততা মানে শুধু সত্য বলা নয়, বরং ব্যবসা বা চাকরিতে ন্যায়ের পথে চলা। ধরো, তুমি একজন ব্যবসায়ী। মুনাফার লোভে যদি নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করো, তাৎক্ষণিকভাবে লাভ হলেও তুমি ক্রেতাদের আস্থা হারাবে। আবার একটি সংস্থার কর্মচারী যদি তার কাজ ঠিকঠাক না করে, সেই প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিই হবে।

আমি একবার এক দোকানদারের কথা শুনেছিলাম যিনি ক্রেতার সাথে কখনোই প্রতারণা করতেন না। প্রথম দিকে তার লাভ কম ছিল, কিন্তু ক্রমে তার সততার জন্য তার দোকান সবার ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছিল। এই হলো সত্যের শক্তি

৩. অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার: সমতা এবং সামঞ্জস্য

বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলে—
“আত্মনো মোক্ষার্থং জগৎ হিতায় চ।”*
অর্থ: নিজের মুক্তির জন্য এবং সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করো।

ন্যায়বিচার মানে হলো—সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতি সুবিচার করা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই সমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রেখো, শুধু নিজের জন্য সম্পদ জমিয়ে রাখলে তুমি সুখী হতে পারবে না। একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি তার সম্পদ সমাজের কল্যাণে ব্যয় করেন।

যেমন ধরো, তুমি একজন বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক। যদি তোমার সংস্থায় কর্মচারীদের ঠিকঠাক বেতন না দাও বা তাদের অধিকার কেড়ে নাও, তাহলে সেটা কখনোই ন্যায়বিচার হবে না। এভাবে তোমার ব্যবসা টিকবে না।

একটি সুন্দর উদাহরণ হলো মহাত্মা গান্ধী। তিনি উপনিষদের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, অর্থনীতির ভিত্তি হতে হবে সর্বজনীন কল্যাণ

৪. অহিংস অর্থনীতি: ভোগের নিয়ন্ত্রণ

ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে—
“ত্যেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ”*
অর্থ: সংযমের মাধ্যমে ভোগ করো।

ভোগের প্রতি সংযম রাখতে পারলে মানুষ অর্থনৈতিক দুর্নীতি এড়াতে পারে। আমি নিজেই একসময় অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা করতাম, পরে বুঝেছি এটা অর্থের অপচয়। যখন তুমি মাত্রাতিরিক্ত ভোগ করতে চাও, তখন তুমি অন্যদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছো।

অর্থনীতি যদি অহিংসা এবং সংযমের উপর দাঁড়ায়, তাহলে সমাজের সবার জন্যই তা কল্যাণকর হবে।

৫. জীবনের লক্ষ্য: অর্থের সঙ্গে ধর্মের সংযোগ

কঠ উপনিষদ আমাদের শেখায়—
“শ্রেয়শ্চ প্রেয়শ্চ মনুষ্যমেতঃ।”*
অর্থ: জীবনে দুটি পথ আছে—শ্রেয় (মঙ্গলকর) এবং প্রেয় (আনন্দদায়ক)। বুদ্ধিমান ব্যক্তি মঙ্গলকর পথটি বেছে নেন।

তুমি যদি অর্থের পিছনে শুধু স্বার্থপর আনন্দের জন্য দৌড়াও, তাহলে তা ক্ষণস্থায়ী হবে। কিন্তু অর্থ যদি ধর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাহলে তা চিরস্থায়ী কল্যাণ বয়ে আনে।

অর্থনীতির সত্যিকার উদ্দেশ্য

তুমি কি কখনো ভেবে দেখেছো—কেন আমরা অর্থ উপার্জন করি? শুধুই বিলাসিতার জন্য, নাকি জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণের জন্য?

উপনিষদ আমাদের শিখিয়েছে যে অর্থের উদ্দেশ্য শুধু নিজেকে সুখী করা নয়, বরং সমাজ ও পরমাত্মার সেবা করা। তাই আসো, আমরা অর্থনীতির ক্ষেত্রে সততা আর ন্যায়বিচারকে আমাদের জীবনের ভিত্তি করি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top