আমরা প্রত্যেকেই জীবনে শান্তি, সাফল্য আর পূর্ণতা খুঁজি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছো, এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য আমাদের নৈতিক ভিত্তিটা কতটা শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন? উপনিষদ হলো সেই আধ্যাত্মিক শাস্ত্র, যা আমাদের জীবনের গভীরতম প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়। এর শিক্ষাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। নৈতিক জীবনযাপন শুধু সমাজের জন্য নয়, আমাদের আত্মার উন্নতির জন্যও অপরিহার্য। চলো, দেখে নিই, উপনিষদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি যা আমাদের নৈতিক জীবনকে পথ দেখাতে পারে।
১. সত্যম্ বদন্তি: সত্যের পথে চলা
“সত্যম্ এবাদ্ধরম্।” – সত্যই ধর্ম। (ছান্দোগ্য উপনিষদ)
সত্য বলার গুরুত্ব সম্পর্কে উপনিষদে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। সত্য শুধুমাত্র মুখের কথা নয়, এটা আমাদের চিন্তা, মনোভাব এবং কাজের মধ্যে ফুটে ওঠা উচিত। একজন সৎ ব্যক্তি নিজের এবং অপরের প্রতি দায়িত্বশীল।
ধরো, কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছো যেখানে মিথ্যা বলে বেরিয়ে আসা সহজ। কিন্তু উপনিষদ শেখায়, তুমি যদি সত্যের পথ ধরো, তোমার জীবনে শান্তি স্থায়ী হবে। যেমন ঋষি হারিদ্রুমত উপনিষদে বলেন— “সত্য আত্মাকে উন্নত করে এবং আমাদের আত্মিক মুক্তির পথ দেখায়।”
তোমার জীবনে যদি কখনো নৈতিক সংকট আসে, মনে রেখো সত্যের চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই। কারণ সত্যই তোমাকে ভেতর থেকে শক্তিশালী করে তুলবে।
২. দম (সংযম): আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি
“দমং তপঃ।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)
উপনিষদে আত্মসংযমের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। আত্মনিয়ন্ত্রণ মানে নিজের ইচ্ছেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। আমরা অনেক সময় ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এমন কাজ করি যা পরবর্তী জীবনে আমাদের দুঃখের কারণ হয়।
উপনিষদের মতে, তিনটি জিনিস আমাদের উন্নতি রোধ করে:
- অতি লোভ
- ইন্দ্রিয়ের অসংযম
- অহংকার
কিছু উদাহরণ দিই। ধরো, তুমি জানো অতিরিক্ত খাবার খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকারক, তবু লোভ সংবরণ করতে পারছো না। ঠিক তেমনি ইন্দ্রিয়দের লাগামছাড়া চলতে দিলে জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
একজন যোগী যেমন তার মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন, তুমিও যদি তোমার ইচ্ছেগুলোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে পারো, তোমার জীবন সুখী হবে।
৩. অহিংসা: সমস্ত জীবের প্রতি দয়া
“অহিংসা পরমো ধর্মঃ।” (শাণ্ডিল্য উপনিষদ)
অহিংসা শুধু শারীরিক আঘাত না করা নয়, এটা মানসিক এবং বাচনিক স্তরেও প্রযোজ্য। অনেক সময় আমরা বাক্যবাণে অন্যকে আঘাত করি, যা রক্তের ক্ষত থেকেও গভীর দাগ ফেলে।
মহর্ষি শাণ্ডিল্য উপনিষদে বলেন, “তুমি যদি অন্যকে কষ্ট দাও, সেটা আসলে তোমার আত্মাকেই কষ্ট দেওয়া।” পৃথিবীর প্রতিটি জীবই পরমাত্মার অংশ, তাই সমস্ত জীবের প্রতি দয়া দেখানোই সত্যিকারের নৈতিকতা।
তুমি কি ভাবতে পারো, পৃথিবীটা কেমন সুন্দর হতো যদি আমরা অহিংসার নীতি মেনে চলতাম? কেবল আমাদের ছোট্ট একটি সিদ্ধান্ত—কোনো মানুষ বা প্রাণীকে কষ্ট না দেওয়া, জীবনকে কতটা শান্তিতে ভরিয়ে দিতে পারে।
৪. অস্তেয় (চুরি না করা): অপরের অধিকারের প্রতি সম্মান
“অস্তেয় পরম ধর্মঃ।”
অস্তেয় অর্থ হলো চুরি না করা, শুধু বস্তুগত চুরি নয়, কারো সময়, প্রশংসা বা অধিকার কেড়ে নেওয়াও চুরি। উপনিষদের মতে, “যে পরিশ্রম করে সে-ই ভোগের অধিকারী।” অন্যের প্রাপ্যকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা মানে নিজের আত্মার ক্ষতি করা।
ধরো, অফিসে তুমি একটি প্রজেক্টের পুরো কৃতিত্ব নিচ্ছো অথচ তোমার সহকর্মীও সেই কাজটিতে সমানভাবে অবদান রেখেছিল। এটা কেমন অন্যায়? একবার ভাবো, এই ক্ষুদ্র অসৎ কাজগুলো কীভাবে আমাদের চরিত্রকে কলুষিত করছে।
অস্তেয় নীতিকে মেনে চললে তোমার সম্মান বাড়বে, আর আত্মতৃপ্তি আসবে। কারণ ন্যায়বোধের চেয়ে বড় সুখ আর কিছু নেই।
৫. শ্রদ্ধা এবং গুরু ভক্তি: জ্ঞানের প্রতি নত হওয়া
“গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করে।” (কৈঠরী উপনিষদ)
উপনিষদে গুরু এবং জ্ঞানের প্রতি ভক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে একজন গুরুর প্রয়োজন হয়। গুরু শুধু বইয়ের জ্ঞান দেন না, তিনি জীবনদর্শনও শেখান।
একটি ছোট গল্প বলি—
একদিন এক শিষ্য তার গুরুকে প্রশ্ন করল, “গুরুদেব, সত্যিকারের জ্ঞান কী?” গুরু বললেন, “তোমাকে আগে নিজের অহংকার ছাড়তে হবে। যতক্ষণ না তুমি বিনম্র হতে পারছো, ততক্ষণ সত্যিকারের জ্ঞান তোমার কাছে ধরা দেবে না।”
গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে জীবনের যে কোনো সমস্যার সমাধান সহজে খুঁজে পাবে।
উপনিষদের নীতিগুলো আমাদের জীবনের দর্পণ
উপনিষদ আমাদের শেখায়, নৈতিক জীবন মানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, সত্যের পথে চলা এবং সকলের প্রতি দয়া দেখানো। আজকের জটিল সমাজেও এই নীতিগুলো প্রাসঙ্গিক। যদি আমরা সত্যি চাই জীবনে মানসিক শান্তি আর আধ্যাত্মিক উন্নতি, তাহলে উপনিষদের এই শিক্ষাগুলোকে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে হবে।
তোমার জীবন কীভাবে পরিবর্তন হতো যদি তুমি সত্যবাদিতা, সংযম, এবং অহিংসার মতো নীতিগুলো পুরোপুরি মেনে চলতে? নিজেকে প্রশ্ন করো এবং দেখো, উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নতুন জীবনের দিশা।
“সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্”— সত্যের পথেই রয়েছে পরম সৌন্দর্য।
4o