আমাদের সনাতন ধর্মে আত্মসংযম বা আত্মনিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত গুণ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। উপনিষদে বারবার আত্মসংযমকে উল্লেখ করা হয়েছে একটি পবিত্র পথ হিসেবে, যা আমাদের ব্রহ্মজ্ঞান লাভে সাহায্য করে। চলুন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উপনিষদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তা আমাদের জীবনে কীভাবে প্রাসঙ্গিক তা বুঝি।
আত্মসংযম: উপনিষদের সংজ্ঞা ও তাৎপর্য
উপনিষদে আত্মসংযম বলতে বোঝানো হয়েছে ইন্দ্রিয়, মন এবং চিন্তার উপর নিয়ন্ত্রণ। বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে,
“আত্মানং বিদ্ধি, আত্মানং সধায়”,
অর্থাৎ নিজের আত্মাকে জানুন এবং আত্মসংযমের মাধ্যমে তাকে শুদ্ধ করুন। মানুষের প্রকৃতি হল বাহ্যিক জগতের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। কিন্তু উপনিষদ আমাদের শিক্ষা দেয়, বাহ্যিক আকর্ষণ থেকে মনকে সরিয়ে অন্তরের দিকে মনোযোগ দেওয়াই আত্মসংযম।
আত্মসংযমের মাধ্যমে মননির্বাণ
কঠ উপনিষদে, একটি অনন্য উদাহরণ ব্যবহার করে আত্মসংযমের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, মন হল ঘোড়ার মতো এবং আত্মা হল রথ। আত্মসংযম ছাড়া এই রথ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। একমাত্র সংযমই পারে আমাদের চঞ্চল মনকে স্থির করতে।
যেমন, একজন কৃষক যদি নিজের জমি নিয়মিত চাষ না করে, তবে সেখানে আগাছা জন্মাবে। তেমনই আত্মসংযম ছাড়া আমাদের জীবনে অশান্তি বাসা বাঁধে।
আত্মসংযমের উদাহরণ: ভগবান রামের চরিত্র
সনাতন ধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল ভগবান রামের জীবন। অযোধ্যার সিংহাসন ত্যাগ করে তিনি নির্বাসনে গিয়েছিলেন। অথচ এত বড় অন্যায় হওয়া সত্ত্বেও তিনি একবারও ক্রোধ প্রকাশ করেননি। এমনকি বনবাসে থাকার সময়ও তিনি সবধরনের ইন্দ্রিয়জ আনন্দকে ত্যাগ করে নিজেকে সংযত রেখেছিলেন। ভগবান রামের চরিত্রে আমরা আত্মসংযমের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।
গুরুদের শিক্ষার ভিত্তি: আত্মসংযম
উপনিষদের শিক্ষায় গুরুদের প্রধান বার্তা ছিল, “তপঃ”। তপ মানে কেবল ধ্যান নয়, বরং ইন্দ্রিয় সংযম। চণ্ডোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, আত্মসংযম ছাড়া জ্ঞান অর্জন অসম্ভব।
একটি সুন্দর গল্প আছে – এক শিষ্য গুরুদেবের কাছে জানতে চাইলেন, জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী। গুরু বললেন, “তুমি প্রথমে ইন্দ্রিয়দের উপর নিয়ন্ত্রণ কর। তারপর তোমার মনকে একাগ্র কর। তখনই তুমি প্রকৃত জ্ঞান লাভ করবে।”
আধুনিক জীবনে আত্মসংযমের প্রাসঙ্গিকতা
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আত্মসংযম অত্যন্ত প্রয়োজন। আধুনিক যুগে মোবাইল, টেলিভিশন এবং অন্যান্য প্রযুক্তি আমাদের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এ সময়ে উপনিষদের আত্মসংযমের শিক্ষা আমাদের শান্তি এবং সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে। প্রতিদিন অন্তত কিছু সময় নিজের আত্মার দিকে মনোনিবেশ করুন। এটি শুধু মানসিক শান্তি দেবে না, বরং জীবনে স্থায়িত্বও আনবে।
সনাতন ধর্মের চিরন্তন সত্য
আমাদের সনাতন ধর্ম বারবার আত্মসংযমের মাধ্যমে জীবনের পরম সত্যে পৌঁছানোর কথা বলেছে। ভগবান কৃষ্ণ গীতায় বলেছেন,
“যঃ সংযতমনঃ সর্বত্র সুখমশ্নুতে”,
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি নিজের মনকে সংযত করতে পেরেছে, সে সর্বত্র সুখ অনুভব করে।
শেষ কথা: ধর্মই পথ প্রদর্শক
আত্মসংযম আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আলোর দিশা দেখায়। এটি আমাদের আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং জীবনে সাফল্য, শান্তি ও ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে। তাই, আসুন আমরা উপনিষদের এই মহান শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনে তা প্রয়োগ করি।
“ধর্মই পরম সুখের পথ।”