সুশাসন সম্পর্কে উপনিষদের কী বক্তব্য আছে?

সুশাসন সম্পর্কে উপনিষদের কী বক্তব্য আছে?

সুশাসন একটি চিরন্তন মূল্যবোধ, যা আমাদের সমাজকে ন্যায়, সত্য এবং ধর্মের পথে পরিচালিত করে। উপনিষদ, সনাতন ধর্মের জ্ঞানভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত এই পবিত্র গ্রন্থে সুশাসনের ধারণা বহু গভীরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি কেবল রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার এবং সমাজের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা দেয়।

উপনিষদের দৃষ্টিতে সুশাসনের ভিত্তি

উপনিষদে সুশাসন কেবল রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়ম নয়, এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মের (নৈতিকতা) অনুসরণ। ঈশা উপনিষদ এর প্রথম মন্ত্রেই বলা হয়েছে:
“ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।”
এর অর্থ, এই জগৎ এবং যা কিছু এর মধ্যে রয়েছে, সবই ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং, ন্যায় এবং ধর্ম অনুসরণ করেই সকল কিছু পরিচালিত হওয়া উচিত।

উপনিষদে শাসকের গুণাবলী নিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে। যেমন, একজন শাসককে নিজের কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হতে হবে এবং প্রজাদের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে। এই শিক্ষা আমরা “কঠ উপনিষদ”-এ দেখতে পাই, যেখানে বলা হয়েছে:
“নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ।”
অর্থাৎ দুর্বল ব্যক্তি আত্মার এবং সত্যের গভীর জ্ঞান লাভ করতে পারে না। তাই একজন শাসকের শক্তিশালী হতে হবে এবং সেই শক্তি ব্যবহার করতে হবে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য।

সুশাসনের গুরুত্ব: উদাহরণ সনাতন ধর্ম থেকে

রাজা হরিশচন্দ্রের কাহিনি

রাজা হরিশচন্দ্র ন্যায়, সত্য এবং ধর্মের প্রতীক। সত্যের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা এবং ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা সুশাসনের একটি মহান উদাহরণ। রাজ্যের শাসন করতে গিয়ে তিনি নিজের সমস্ত সম্পদ ত্যাগ করেন, কিন্তু প্রজাদের প্রতি তাঁর দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি।

শ্রী রামের জীবন দর্শন

শ্রী রাম, যাঁকে “মর্যাদা পুরুষোত্তম” বলা হয়, তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ সুশাসনের উদাহরণ। রামরাজ্যের ধারণা উপনিষদে বর্ণিত ন্যায়, ধর্ম এবং প্রজাদের প্রতি শাসকের দায়িত্বের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। শ্রী রাম সর্বদা তাঁর প্রজাদের কল্যাণে কাজ করেছেন এবং নিজেও ধর্মের পথে অবিচল থেকেছেন।

রাজা যুধিষ্ঠিরের দৃষ্টান্ত

মহাভারতের রাজা যুধিষ্ঠিরও সুশাসনের একটি নিখুঁত উদাহরণ। তিনি সর্বদা ধর্ম, ন্যায় এবং প্রজাদের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। “শান্তি পর্ব”-এ দেখা যায়, তিনি যুদ্ধের পরে প্রজাদের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালন করার জন্য শাসনব্যবস্থায় কীভাবে পরিবর্তন আনেন।

সুশাসনের ব্যক্তিগত দিক

উপনিষদে কেবল রাজা বা শাসকের সুশাসন নিয়ে কথা বলা হয়নি, ব্যক্তিগত সুশাসনের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যদি আমরা সত্য, ন্যায় এবং ধর্ম মেনে চলি, তবে নিজেই নিজের জীবনের শাসক হয়ে উঠতে পারি।

“সত্যমেব জয়তে নানৃতং” (মুন্ডক উপনিষদ) – সত্যের পথই সর্বোচ্চ। সুশাসনের মূল ভিত্তি এই সত্যে নিহিত। সত্য এবং ন্যায়ের পথ অনুসরণ করলেই জীবনে সফলতা এবং শান্তি আসবে।

আধুনিক জীবনে সুশাসনের উপনিষদীয় প্রয়োগ

আজকের সমাজেও উপনিষদের এই শিক্ষাগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ন্যায় এবং সত্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে নিজের জীবনে, পরিবারে এবং সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদি প্রতিটি মানুষ নিজের নৈতিক দায়িত্ব পালন করে, তবে সমাজে শান্তি এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে।

উপনিষদ আমাদের যে শিক্ষা দেয়, তা হলো:
“ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ”।
অর্থাৎ ধর্মকে রক্ষা করলে ধর্ম আমাদের রক্ষা করবে। এটি সুশাসনের সারমর্ম, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top