সনাতন ধর্মে প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং যত্ন নেওয়ার শিক্ষা বারবার দেওয়া হয়েছে। উপনিষদে বলা হয়েছে, “ঐশ্বর্যময় প্রকৃতি ঈশ্বরেরই অংশ, সুতরাং প্রকৃতির সংরক্ষণ ও যত্ন নেওয়া আমাদের কর্তব্য।” বর্তমান সময়ে পরিবেশ দূষণ এক গুরুতর সমস্যা। সনাতন ধর্মের দর্শন অনুসারে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা একধরনের পূজা, যা আমাদের আত্মিক উন্নতি এবং মানবজীবনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এখানে উপনিষদের শিক্ষার আলোকে পরিবেশ দূষণ ঠেকানোর কিছু উপায় নিয়ে আলোচনা করব।
১. অহিংস জীবনযাপন:
উপনিষদে বারবার অহিংসা বা “অহিংস পরম ধর্মঃ” এর উপর জোর দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হলো অতিরিক্ত ভোগবাদী জীবনযাপন। আমরা যখন অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করি, তখন প্রকৃতিকে আঘাত করি। অহিংস জীবনযাপনের মাধ্যমে আপনি কম উপভোগে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন। যেমন—অপ্রয়োজনীয় প্লাস্টিক ব্যবহার এড়ানো, পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ব্যবহার করা এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য গ্রহণ করা।
২. প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ:
উপনিষদে বলা হয়েছে, “ইশাবাস্যম্ ইদং সর্বং”—এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি জিনিস ঈশ্বরেরই অংশ। তাই, আমরা যা কিছু ব্যবহার করি, তা প্রকৃতির দান। প্রতিদিন প্রকৃতিকে ধন্যবাদ জানানো এবং তার প্রতি যত্ন নেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। উদাহরণস্বরূপ, বৃক্ষরোপণ বা গাছ লাগানোর মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি।
৩. সীমিত ভোগবিলাস:
“তৈত্তিরীয় উপনিষদে” উল্লেখ করা হয়েছে, অতিভোগ আমাদের মানসিক ও শারীরিক শান্তি নষ্ট করে। পরিবেশ দূষণের বড় কারণ হলো মানুষের চাহিদার সীমাহীনতা। আমাদের উচিত সীমিত সম্পদ ব্যবহার করা এবং প্রাকৃতিক জিনিসের অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। উদাহরণস্বরূপ, কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করা, বর্জ্য কমানো এবং জৈব পদ্ধতিতে কৃষি কার্যকলাপ পরিচালনা করা।
৪. পঞ্চভূতকে রক্ষা:
সনাতন ধর্মে পঞ্চভূতের (পৃথিবী, জল, আগুন, বায়ু, আকাশ) প্রতি যত্ন নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি প্রতিদিন এই পঞ্চভূতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই এবং দূষণ না করি, তাহলে প্রকৃতি তার ভারসাম্য বজায় রাখে। যেমন—পানির অপচয় বন্ধ করা, বায়ুদূষণ কমানোর জন্য সাইকেল চালানো, এবং জৈব সার ব্যবহার করা।
৫. যজ্ঞের প্রভাব:
উপনিষদ ও বেদে যজ্ঞের গুরুত্ব আলাদা করে বলা হয়েছে। যজ্ঞ কেবলমাত্র ধর্মীয় আচার নয়, এটি পরিবেশের শুদ্ধিকরণেও সহায়ক। বৈদিক যুগে যজ্ঞের মাধ্যমে বায়ুকে শুদ্ধ করা হতো। যদিও আধুনিক কালে বড় আকারে যজ্ঞ সম্ভব নয়, তবে আমরা ছোটখাটো ধর্মীয় আচার পালন করতে পারি যা পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়।
উদাহরণ: পরিবেশ রক্ষার বার্তা সনাতন ধর্মের ঘটনা থেকে
১. মহাভারতে অর্জুনের গন্ধমাদন পাহাড় ভ্রমণ: অর্জুন যখন গন্ধমাদন পাহাড়ে যান, তখন তিনি সেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে প্রার্থনা করেন এবং বলেন যে এটি রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।
২. রামায়ণে পঞ্চবটী অরণ্যের গুরুত্ব: শ্রী রাম ও সীতা যখন পঞ্চবটীতে ছিলেন, তারা সেখানে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করেছেন এবং কখনও প্রাকৃতিক সম্পদ অপচয় করেননি।
৬. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা:
উপনিষদে উল্লেখ রয়েছে, “শুচি” বা শুদ্ধতার গুরুত্ব। আমাদের ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে আমাদের চারপাশের পরিবেশ পর্যন্ত পরিষ্কার রাখা উচিত। প্লাস্টিক বা বিষাক্ত বর্জ্য না ফেলে, সেগুলি সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহার করতে হবে।
সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেই ভবিষ্যৎ রক্ষা
আমাদের সনাতন ধর্মের শিক্ষা কেবল ধর্মীয় নয়, এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। যদি আমরা উপনিষদের শিক্ষাগুলি মেনে চলি, তবে পরিবেশ দূষণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে প্রকৃতিকে রক্ষা করার এই পথচলায় শামিল হই। মনে রাখবেন, “ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ”—যে ধর্মকে রক্ষা করে, সেই ধর্মই তাকে রক্ষা করে। প্রকৃতি সংরক্ষণই সনাতন ধর্মের প্রকৃত অনুসরণ।