সনাতন ধর্মের অন্যতম বিশেষ দিক হলো প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন। এটি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতা নয়, বরং জীবনযাপনের একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি। নিরামিষ আহারকে সনাতন ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র বলে গণ্য করা হয়। উপনিষদের দর্শন অনুসারে, নিরামিষাশী হওয়া কেবল শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য নয়, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যও অপরিহার্য।
উপনিষদের দৃষ্টিভঙ্গি
ইশোপনিষদে বলা হয়েছে:
“ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত।”
এই শ্লোকটি প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীবের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নিরামিষ আহারের মাধ্যমে আমরা এই দায়বদ্ধতার প্রতি সম্মান জানাই। আমরা যদি প্রাকৃতিক উপাদানগুলিকে শোষণ না করে ব্যবহার করি, তবে তা আমাদের জীবনে ইতিবাচক শক্তি আনবে।
ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে যে, “যেমন আহার, তেমন মন”। এটি প্রমাণ করে যে, নিরামিষ আহার গ্রহণ করলে আমাদের মন আরও শান্ত, পবিত্র এবং দয়ালু হয়ে ওঠে। মাংসাশী খাদ্য আমাদের মধ্যে হিংস্রতা এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করে, যা আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে বাধা হতে পারে।
সনাতন ধর্মে নিরামিষাশী হওয়ার উদাহরণ
আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলি নিরামিষ আহারের পক্ষে উদাহরণে ভরপুর।
১. ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনে নিরামিষ খাদ্যের ভূমিকা
গোকুলে শ্রীকৃষ্ণ এবং গোপালদের দিনগুলি ছিল দুধ, মাখন, ফলমূল এবং দুধজাত খাবারের উপর নির্ভরশীল। গোপালন এবং প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমে কৃষ্ণ আমাদের শিক্ষা দেন যে, জীব হত্যা না করে প্রকৃতির দান গ্রহণ করাই শ্রেষ্ঠ পন্থা।
২. মহর্ষি পাটঞ্জলি ও যোগশাস্ত্র
যোগশাস্ত্রে নিরামিষাশী খাদ্যকে সত্ত্বিক (পবিত্র) খাদ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাটঞ্জলির যোগসূত্র অনুসারে, যে আহার সত্ত্বিক, তা আমাদের শরীর এবং আত্মাকে পবিত্র করে। এটি মনকে শান্ত এবং স্থির রাখে, যা ধ্যান এবং যোগচর্চার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. রাজা অশোকের নিরামিষ জীবনযাপন
বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর রাজা অশোক নিরামিষ জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রাণী হত্যা বন্ধ করা এবং নিরামিষ আহারে অভ্যস্ত হওয়া মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।
নিরামিষ আহারের বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
নিরামিষ খাদ্য আমাদের শরীরে সঠিক পুষ্টি সরবরাহ করে। এটি সহজে হজম হয় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। উপনিষদে বলা হয়েছে, “অন্নম ব্রহ্ম” অর্থাৎ, আহারই ব্রহ্ম। যা আমরা গ্রহণ করি, তা আমাদের শরীর এবং আত্মাকে গঠন করে। নিরামিষ খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমরা আত্মিক শক্তি অর্জন করতে পারি।
হিংসা পরিত্যাগের গুরুত্ব
মহাভারতে উল্লেখ আছে, “অহিংসা পরমো ধর্ম:”। নিরামিষাশী হওয়া মানে অহিংসার পথে চলা। আমরা যখন প্রাণীদের হত্যা করি না এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করি, তখন আমরা প্রকৃতির সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষা করি। এই পথ আমাদের সত্য, দয়া এবং করুণার দিকে পরিচালিত করে।
আমাদের দায়িত্ব
আপনি কি জানেন, নিরামিষাশী হওয়া আমাদের পৃথিবীর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ? প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হলে মাংসাশী খাদ্যের পরিবর্তে নিরামিষ আহার বেছে নিতে হবে। এতে জল, মাটি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় অনেকাংশে কমে।
নিরামিষ আহার আমাদের সত্ত্বিক গুণকে জাগ্রত করে। আমাদের কর্ম, চিন্তা এবং আচরণ আরও শুদ্ধ হয়। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে আমরা সনাতন ধর্মের মূল বার্তাকে আরও সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারি।
“ধর্মশ্চার্থশ্চ কামশ্চ মোক্ষশ্চ ইহৈব জিভ্যস্য।”
অর্থাৎ, সঠিক আহার গ্রহণ করে আমাদের জীবনের চারটি উদ্দেশ্যই অর্জন সম্ভব।