সনাতন ধর্মের গভীর দার্শনিক গ্রন্থ উপনিষদে আমরা প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যে গভীর সম্পর্কের উল্লেখ পাই। যদিও “জলবায়ু পরিবর্তন” শব্দটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণের বার্তা উপনিষদে বহু জায়গায় আছে। আসুন, উপনিষদ থেকে আমরা কীভাবে এই বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করতে পারি, তা নিয়ে আলোচনা করি।
প্রকৃতির প্রতি সম্মান: যজ্ঞের ধারণা
উপনিষদের কেন্দ্রীয় শিক্ষা হলো সৃষ্টির প্রতিটি উপাদানের মধ্যে ঐক্য এবং ভারসাম্য বজায় রাখা। ঋগ্বেদের পুরুষসূক্তে উল্লেখ আছে যে সমস্ত প্রকৃতি, যেমন জল, বায়ু, অগ্নি, এবং পৃথিবী, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অংশ। যজ্ঞের মাধ্যমে এই উপাদানগুলোকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। যজ্ঞের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা, যা জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
আমরা যদি যজ্ঞকে প্রতীকীভাবে দেখি, এটি বোঝায় যে আমাদের আচরণে এমন ভারসাম্য থাকা উচিত যা প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে। উদাহরণস্বরূপ, আজকের দিনে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ এবং বন উজাড় করা যজ্ঞের মূল দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত।
পরিবেশ রক্ষার বার্তা: ঈশোপনিষদ
ঈশোপনিষদ একটি অসাধারণ দর্শনের গ্রন্থ যেখানে বলা হয়েছে:
“ঈশা বাস্যমিদং সর্বং, যৎ কিন্চ জগত্যাং জগৎ।”
অর্থাৎ, এই জগতে যা কিছু আছে, তা ঈশ্বরের দ্বারা পরিব্যাপ্ত। এই শ্লোকটি আমাদের শিখায় যে আমরা প্রকৃতির মালিক নই; আমরা কেবল এর রক্ষক।
আমাদের পরিবেশ এবং সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার আসলে ঈশ্বরের সৃষ্টি ধ্বংস করার সমান। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে যেমন অরণ্যনিধন, বায়ুদূষণ এবং অতিরিক্ত শিল্পায়ন রয়েছে—এগুলো ঈশ্বরের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা নির্দেশ করে।
উদাহরণ: কৃষ্ণ ও গোপালন
শ্রীকৃষ্ণের গোপালন লীলা প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের অন্যতম উদাহরণ। গোকুল এবং বৃন্দাবনের জীবনযাত্রা ছিল প্রকৃতি-কেন্দ্রিক। শ্রীকৃষ্ণ যখন গো-বলয়ের রক্ষা করতেন, তখন এটি কেবল গো-পালন নয়, বরং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা এবং তার পুনর্নবীকরণও ছিল।
আমরা যদি আজকের কৃষ্ণলীলা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি, তবে আমাদের জীবনযাত্রায় একটি টেকসই পদ্ধতির প্রয়োজন। এটি জল সংরক্ষণ, গাছ লাগানো, এবং প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট না করার মতো কাজগুলোর মাধ্যমে সম্ভব।
প্রকৃতির রক্ষায় আমাদের করণীয়
উপনিষদের আলোকে আমরা শিখি যে, মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে একটি পারস্পরিক নির্ভরশীল সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান জলবায়ু সংকট কেবল প্রকৃতির ওপর নয়, বরং আমাদের অস্তিত্বের ওপরেও হুমকি তৈরি করেছে।
সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা হলো ধর্ম (নীতি), অর্থ (সমৃদ্ধি), কাম (আকাঙ্ক্ষা), এবং মোক্ষ (মুক্তি)। যদি আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করি, তবে এই চতুর্ভুজ লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আমাদের জীবনযাত্রায় কয়েকটি পরিবর্তন আনলে আমরা উপনিষদের মূল বার্তাগুলো পালন করতে পারি:
- সংযম ও দায়িত্বশীলতা: অপ্রয়োজনীয় ভোগবাদ বন্ধ করা।
- প্রকৃতির পুনর্নবীকরণ: বৃক্ষরোপণ এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার।
- সজাগতা ও সচেতনতা: পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং অন্যদের সচেতন করা।
পরিশেষে: “বসুধৈব কুটুম্বকম”
উপনিষদের এই চিরন্তন মন্ত্রটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সমগ্র পৃথিবী এক পরিবার। প্রকৃতি, প্রাণী, এবং মানুষ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
আপনি, আমি—আমরা সবাই যদি আমাদের ক্ষুদ্র ভূমিকা পালন করি, তবে প্রকৃতির এই ভারসাম্য আবার ফিরে আসবে। চলুন, সনাতন ধর্মের চেতনার আলোকে এই পৃথিবীকে রক্ষা করি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ রেখে যাই। “ওঁ শান্তি: শান্তি: শান্তি:”