আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জানেন, সনাতন ধর্মের দর্শনে প্রকৃতি, গাছপালা, পশুপাখি, এবং সমস্ত জীবজন্তুকে এক অভিন্ন চেতনার অংশ হিসাবে দেখা হয়। এই ভাবনা সরাসরি উপনিষদের শিক্ষা থেকে এসেছে। উপনিষদ আমাদের শিখিয়েছে যে জগতে যা কিছু আছে, তা পরমাত্মার (ব্রহ্ম) থেকে উদ্ভূত এবং সেই পরমাত্মাতেই অবস্থিত। ফলে, গাছপালা ও পশুপাখি আমাদের থেকে পৃথক কিছু নয়, তারাও একই চেতনার অংশ।
উপনিষদ ও প্রকৃতি-চেতনা
উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে যে সৃষ্টির প্রতিটি কণায় ঈশ্বর বিদ্যমান।
“ঈশা বাস্যমিদং সর্বং” (ঈশোপনিষদ) শ্লোকে এই চিরন্তন সত্য উচ্চারিত হয়েছে, সমগ্র বিশ্বই ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছাদিত।
তাই, গাছপালা বা পশুপাখিকে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ বা উপকরণ হিসেবে দেখাটা সনাতন দর্শনের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। তাদের প্রতিটি জীবনের মূল্য অপরিসীম এবং পবিত্র।
গাছপালার গুরুত্ব: প্রকৃতির প্রাণশক্তি
গাছপালা শুধু প্রকৃতির শোভা বাড়ায় না, তারা প্রকৃতির অমৃতস্বরূপ। তैত্তিরীয় উপনিষদে বর্ণিত হয়েছে যে “অন্নম হি প্রজাপতিঃ” অর্থাৎ অন্ন বা খাদ্য সৃষ্টির মূল। গাছপালা এই অন্নের প্রধান উৎস, যা আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, গাছপালা আমাদের বায়ু, পানি, এবং পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে।
উপনিষদের দৃষ্টিতে, গাছ একটি জীবন্ত সত্তা। বৃক্ষের প্রতিটি অংশ—মূল, কান্ড, পাতা—ঈশ্বরের উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে। এই কারণে, প্রাচীন ভারতে গাছপালাকে পূজা করার প্রচলন ছিল। পিপল গাছকে (অশ্বত্থ) “ক্ষয়মুক্ত” বা চিরজীবী গাছ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এটি ভগবান বিষ্ণুর সঙ্গে যুক্ত।
পশুপাখি: সহচর ও সেবক
পশুপাখির ক্ষেত্রেও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাই। উপনিষদ বলে, প্রত্যেক জীবই পরমাত্মার অংশ, তাই তাদের সেবা করা মানে ঈশ্বরের সেবা করা। প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে বিভিন্ন দেবতার বাহন হিসেবে পশুপাখিদের উল্লেখ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মা দুর্গার বাহন সিংহ, ভগবান বিষ্ণুর বাহন গরুড়, এবং শ্রী গণেশের বাহন ইঁদুর। এগুলো শুধু কাহিনির অংশ নয়; বরং এটি বোঝায় যে মানুষের পাশাপাশি প্রাণিকূলও সৃষ্টির এক অমূল্য অংশ।
প্রকৃতি সংরক্ষণ: উপনিষদের বার্তা
উপনিষদ আমাদের শুধু প্রকৃতিকে সম্মান করতে বলেনি, বরং তাকে রক্ষা করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছে। একথা ভাবুন—যদি গাছপালা না থাকে, তাহলে আমাদের শ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেন আসবে কোথা থেকে? পশুপাখি না থাকলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। তাই, তাদের সংরক্ষণ করা আমাদের ধর্মীয় এবং নৈতিক দায়িত্ব।
“মাতৃভূমিঃ পৃথিবী চ” (অর্থাৎ পৃথিবী আমাদের মা)—এই ভাবনা অনুযায়ী, আমরা যেমন মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন করি, তেমনই প্রকৃতি এবং জীবজন্তুর প্রতিও আমাদের ভালোবাসা ও সুরক্ষার দায় রয়েছে।
আপনার ও আমার করণীয়
উপনিষদে শিক্ষা শুধু মন্ত্রোচ্চারণ বা পঠন-পাঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আমাদের জীবনে প্রয়োগ করার জন্য। প্রতিদিন আমরা যদি একটি গাছ রোপণ করি, পশুপাখিদের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করি, তাহলে তা ঈশ্বরের প্রতি প্রকৃত ভক্তি প্রকাশ করবে। আপনি যখন একটি পাখির জন্য দানা ছড়িয়ে দেন, একটি ক্ষুধার্ত কুকুরকে রুটি খাওয়ান, তখনই আপনি এই উপনিষদীয় চেতনার বাস্তব প্রয়োগ করেন।
উপসংহার
উপনিষদ আমাদের শেখায়, সৃষ্টির প্রতিটি জীবই এক। গাছপালা ও পশুপাখি আমাদের ভাইবোনের মতো; তারা ঈশ্বরের অঙ্গ। তাদের প্রতি ভালোবাসা ও যত্ন দেখানো মানে প্রকৃত অর্থে ঈশ্বরকে সেবা করা। তাই আসুন, আমরা সবাই প্রকৃতি ও জীবজগতের প্রতি দায়িত্বশীল হই এবং উপনিষদের এই শিক্ষা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি।
“সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শন”-এর চেতনা ধারণ করে প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।