উপনিষদে সম্পদের প্রতি আসক্তি নিয়ে কোনো সতর্কতা আছে?

উপনিষদে সম্পদের প্রতি আসক্তি নিয়ে কোনো সতর্কতা আছে?

উপনিষদ—ভারতীয় জ্ঞানের এমন এক শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থ, যা শুধু আধ্যাত্মিক জগতের পথই দেখায় না, বরং বাস্তব জীবনের জন্যও অমূল্য শিক্ষায় ভরপুর। আমরা যখনই “সম্পদ” শব্দটি শুনি, তখন মনে হয় এটি আমাদের জীবনের প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু সম্পদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি আমাদের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে উপনিষদ বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, আজকের আধুনিক সমাজেও উপনিষদের এই শিক্ষা প্রাসঙ্গিক।

সম্পদের মোহ কেন বিপজ্জনক?

সম্পদ আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ এবং আরামদায়ক করে তোলে, তবে যখন এই সম্পদই আমাদের মন-মগজকে গ্রাস করে, তখন তা ধ্বংসের কারণ হয়ে ওঠে। ঈশোপনিষদ-এর একটি বিখ্যাত শ্লোক এখানে বিশেষভাবে স্মরণীয়—

“ত্বং বুহ্নি ত্যাগেন ভুঞ্জীথা, মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্।”
(ঈশোপনিষদ, শ্লোক ১)

অর্থাৎ, “এই পৃথিবীর সমস্ত কিছুই ঈশ্বরের দ্বারা বেষ্টিত। তুমি ভোগ করবে, কিন্তু ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে। অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ করো না।”

এই শ্লোক আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সম্পদ ভোগ করা দোষের নয়, কিন্তু তা যদি লোভে পরিণত হয়, তবে তা আমাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

আসক্তির বাস্তব উদাহরণ: লোভ ও ভোগের পরিণতি

চলো, আমরা কিছু বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে এই শিক্ষা আরও গভীরভাবে বুঝি।

১. রাজা জনক ও তার ত্যাগের শিক্ষা

রাজা জনকের প্রসঙ্গ তো আমরা সবাই জানি। তিনি ছিলেন এক মহান রাজা, যিনি অসংখ্য সম্পদের মালিক ছিলেন। কিন্তু তার মন সবসময়ই সম্পদের প্রতি নিরাসক্ত ছিল। একবার একজন ঋষি তাঁকে প্রশ্ন করলেন, “আপনার এত রাজ্য, এত ধনসম্পদ—এগুলো কি আপনাকে বাঁধে না?” রাজা জনক তখন হাসতে হাসতে বললেন, “আমি শুধু বাহ্যিক সম্পদের মালিক। কিন্তু আমার অন্তর সবসময় মুক্ত। সম্পদ আমার মনকে গ্রাস করতে পারে না।”

জনকের এই নিরাসক্তির শিক্ষা আমাদের শেখায় যে, সম্পদের মধ্যে থেকেও যদি আমরা আসক্তি মুক্ত থাকতে পারি, তাহলেই প্রকৃত শান্তি লাভ সম্ভব।

২. সম্পদের প্রতি আসক্তির ফল: “যে বেশি চায়, সে হারায়”

কথায় বলে, “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।” এই কথা উপনিষদের গভীর তত্ত্বেও প্রমাণিত। আসলে সম্পদের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি আমাদের মধ্যে অহংকার, ঈর্ষা ও অনৈতিক আচরণ তৈরি করে। কঠোপনিষদে একটি ঘটনার কথা বলা হয়েছে—

যখন নচিকেতা মৃত্যুর দেবতা যমের কাছে গিয়েছিলেন, তখন যম তাঁকে অসীম সম্পদের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর প্রশ্ন এড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নচিকেতা বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন—

“অন্য মানুষকে যে ভোগান্তি দেয়, সে কখনো শান্তি পায় না।”

এর মাধ্যমে নচিকেতা আমাদের শেখায়, আসল সম্পদ হলো আত্মজ্ঞান, যেটি অর্জন করলে আমরা জীবনের সমস্ত আসক্তি ও ভোগবিলাসকে অতিক্রম করতে পারি।

৩. ভোগের সীমা: আমাদের বাস্তব জীবনেও প্রযোজ্য

আজকের দুনিয়ায় আমরা চারদিকে তাকালে দেখি—লোকেরা সম্পদের পেছনে ছুটছে। কেউ একগাদা টাকা রোজগার করতে চায়, কেউ বড় বাড়ি, গাড়ি, আরামদায়ক জীবন। কিন্তু এই দৌড় কি কখনো শেষ হয়?

উপনিষদ বলে—

“আত্মানং বিদ্ধি: নিজেকে জানো, তাহলেই শান্তি পাবে।”

অর্থাৎ, বাইরে সম্পদ খোঁজা অর্থহীন, যদি নিজের মধ্যে শান্তি না থাকে। সম্পদের ভোগের সীমা থাকলে আমরা যেমন সুখী হতে পারি, তেমনই আমাদের সমাজ ও পরিবেশেরও উন্নতি হয়।

উপনিষদের ত্যাগের শিক্ষা: ত্যাগেই শান্তি

উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে “ত্যাগ” শব্দটি। তবে এটি অর্থহীন সবকিছু ছেড়ে দেওয়া নয়, বরং আসক্তিকে ছেড়ে দেওয়া। যখন আমরা সম্পদকে প্রয়োজনের সীমায় রাখি এবং লোভকে ত্যাগ করি, তখনই আমরা প্রকৃত শান্তির সন্ধান পাই।

“ন তস্য প্রাণা উচ্ছেদ্যঃ।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)
অর্থাৎ, “যিনি লোভমুক্ত, তাঁর জীবন কখনো বিচলিত হয় না।”

এই কথার গভীরে নিহিত সত্য হলো—সম্পদের প্রতি আসক্তি আমাদের চঞ্চল ও অস্থির করে তোলে। অথচ আসক্তিমুক্ত হলে জীবন হয়ে ওঠে প্রশান্ত।

কীভাবে সম্পদের প্রতি আসক্তি থেকে মুক্ত হবেন?

এখন প্রশ্ন আসে, বাস্তব জীবনে কীভাবে আমরা এই আসক্তি কাটিয়ে উঠবো?

  •  ধন-সম্পদকে ঈশ্বরের দান বলে মনে করা— মনে রাখতে হবে, যা আমাদের কাছে আছে, তা সবই ঈশ্বরের দান। আমরা কেবল তার রক্ষণকারী।
  •  দান করার অভ্যাস গড়ে তোলা— আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে দানকে সবচেয়ে বড় গুণ হিসেবে দেখা হয়েছে। দান করলে লোভ কমে যায়।
  •  আধ্যাত্মিক চর্চা করা— প্রতিদিন কিছু সময় ধ্যান ও উপনিষদের পাঠ করলে আমরা সহজেই মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি।

উপসংহার: সম্পদের প্রকৃত ব্যবহার কী?

উপনিষদের শিক্ষা খুব স্পষ্ট—সম্পদ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু তা কখনো জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। লক্ষ্য হওয়া উচিত আত্মজ্ঞান ও পরমাত্মার সঙ্গে মিলন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top