ধন-সম্পত্তি ও সুখের মধ্যে সম্পর্ক কী?

ধন-সম্পত্তি ও সুখের মধ্যে সম্পর্ক কী?

আমাদের আধুনিক জীবনে একটা সাধারণ ভুল ধারণা প্রচলিত—যত বেশি ধন-সম্পত্তি, তত বেশি সুখ। অনেকেই সারাজীবন দৌড়ে চলেছি সম্পদের পেছনে, ভাবছি একদিন টাকা-পয়সা সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। কিন্তু সত্যিই কি তা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে উপনিষদ-এর গহীন শিক্ষার কাছে।

উপনিষদ বলে—“সুখ আসে আত্মার উপলব্ধি থেকে, বাইরের জগতের বস্তু থেকে নয়।” আজকের দিনে এই সহজ সত্যকে বোঝা যেন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই চলুন, একসঙ্গে দেখি ধন-সম্পত্তির সাথে সুখের সম্পর্ক কী এবং কীভাবে আমরা সত্যিকারের সুখের সন্ধান পেতে পারি।

উপনিষদের শিক্ষা: ধন না আত্মা?

উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে, “ন সম্পত্তি সুখং লভতে।” অর্থাৎ, শুধুমাত্র ধন-সম্পত্তি অর্জন করলেই সুখ আসবে না। সুখ হল আমাদের মন ও আত্মার এক গভীর অনুভূতি, যা বাইরের বস্তু দিয়ে অর্জন করা যায় না।

উদাহরণস্বরূপ, ইশোপনিষদে একটি সুন্দর শ্লোক আছে—

“ত্বং তু ভুঞ্জীথা মাগৃধঃ কস্যস্বিত্ ধনম্।”
অর্থ: মানুষকে তার প্রয়োজন মতোই ভোগ করা উচিত, কিন্তু অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ করা উচিত নয়।

এই শিক্ষাটি আমাদের শেখায় যে অতিরিক্ত ধন-সম্পত্তির পেছনে ছুটে লাভ নেই। নিজের প্রয়োজন মিটলেই তো সুখী হওয়া যায়। তবে আমরা ভুল করি যখন ধনকে সুখের একমাত্র উৎস বলে ধরে নিই।

আমাদের জীবনের বাস্তব উদাহরণ

আমরা যদি একটু চারপাশে তাকাই, দেখব যে ধনবান লোকেরাও প্রায়ই মানসিক শান্তি খুঁজে পান না। অনেক কোটিপতিকে দেখেছি—বাড়ি-গাড়ি সব আছে, অথচ তাদের হাসি নেই।

একটি ছোট গল্প বলি
একবার একজন রাজা ছিলেন, যার প্রাসাদে অগণিত ধন-সম্পত্তি ছিল। তবুও তিনি সুখী ছিলেন না। তিনি এক সন্ন্যাসীর কাছে গেলেন ও বললেন, “আমার সব কিছু আছে, তবু কেন আমি শান্তি পাই না?” সন্ন্যাসী তখন বললেন, “আপনি কি কখনও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন, বা কোনো গরিব মানুষের সাহায্য করেছেন?” রাজা মাথা নাড়লেন। সন্ন্যাসী বললেন, “আপনার ধন নয়, আপনার হৃদয়ের দানই শান্তি আনবে।”

এই গল্প থেকে আমরা কী শিখছি? ধন-সম্পত্তি কখনোই আমাদের আত্মিক তৃপ্তি এনে দিতে পারে না। বরং প্রকৃত সুখ আসে যখন আমরা আমাদের আত্মার উপলব্ধি করি

শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা: ধন হল বিষম মদ

আমাদের শাস্ত্রগুলি শুধু ধন-সম্পত্তির বিরোধিতা করেনি, বরং বলেছে, “ধন যেন বিষম মদের মতো।” শ্রীরামকৃষ্ণ একবার বলেছিলেন—

“যদি তোমার ঘরে ধন থাকে, তার ওপরে মন দিও না। ধন থাকুক, কিন্তু মন যেন ঈশ্বরের দিকে থাকে।”

এটি আসলে উপনিষদের সেই শিক্ষাকেই তুলে ধরে—ধন-সম্পত্তি প্রয়োজন, কিন্তু সেটিকে জীবনের লক্ষ্য বানানো উচিত নয়। আমাদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত আত্মজ্ঞান ও সত্যিকারের সুখের সন্ধান করা।

উপনিষদের বাস্তব শিক্ষা: প্রয়োজন ও লোভের মধ্যে পার্থক্য

উপনিষদে বলা হয়েছে যে “সংযমই সুখের চাবিকাঠি”। জীবনকে সুন্দরভাবে বাঁচতে গেলে প্রয়োজনের সীমারেখা বুঝতে হবে। যখন আমরা প্রয়োজন ও লোভের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখি, তখনই সত্যিকারের শান্তি আসতে শুরু করে।

প্রাচীন ভারতীয় জীবনশৈলী ছিল সংযমের উপর ভিত্তি করে। তারা জানত—“অধিক ধন-সম্পত্তি মানেই বেশি দায়িত্ব।” এই অতিরিক্ত দায়িত্ব মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, যা সুখকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে দেয়।

কেন সম্পদ আমাদের স্থায়ী সুখ দিতে পারে না?

বাহ্যিক সম্পদ, অর্থ, গাড়ি, বাড়ি—এসবের একটা সীমা আছে। যতক্ষণ এগুলো নতুন থাকে, ততক্ষণ আনন্দ দেয়। কিন্তু একসময় এই বস্তুগুলো আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন আবার নতুন কিছু চাই। এই চাহিদার কোনো শেষ নেই।

উপনিষদে বলা হয়েছে—

“আত্মনং বিদ্ধি।”
অর্থাৎ, নিজের প্রকৃত সত্ত্বাকে জানো। সুখ আসবে সেই সত্যকে উপলব্ধি করলেই।

কীভাবে উপনিষদের শিক্ষা জীবনে প্রয়োগ করবেন?

  •  ধনকে লক্ষ্য নয়, মাধ্যম বানান: টাকা-পয়সা জীবনের প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করবে, কিন্তু সেটা জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না।
  •  সংযম অভ্যাস করুন: প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভোগ এড়িয়ে চলুন।
  •  দানের আনন্দ অনুভব করুন: উপনিষদ বলে—“দানই সত্যিকারের সুখের উৎস।” অন্যের জন্য কিছু করার আনন্দ অর্থের চেয়েও বড়।
  •  আত্মচিন্তা ও ধ্যানের মাধ্যমে সুখ খুঁজুন: প্রতিদিন একটু সময় নিজেকে দিন। ধ্যানের মাধ্যমে নিজের সত্ত্বার কাছে পৌঁছন।
  •  বাহ্যিক বস্তু নয়, অভ্যন্তরীণ তৃপ্তি খুঁজুন: জীবনের আসল আনন্দ আসে আত্মার শান্তি থেকে, বস্তু থেকে নয়।

শেষ কথা: সত্যিকারের সুখ কোথায়?

উপনিষদ আমাদের শেখায়—সুখ কখনোই বাইরের জগতে নেই। ধন-সম্পত্তি জীবনকে সহজ করতে পারে, কিন্তু সেটি আমাদের মনকে শান্ত করতে পারবে না। সত্যিকারের সুখ খুঁজতে গেলে আমাদের নিজের আত্মার দিকে ফিরতে হবে।

আজ আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করুন—আপনার জীবনে ধন-সম্পত্তি যতটা দরকার, তার চেয়েও কি বেশি চাহিদা তৈরি করেছেন? সেই অতিরিক্ত চাহিদার ভার কি আপনাকে সত্যিকারের সুখ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে না?

উপনিষদের শিক্ষা অনুসরণ করুন, জীবনে প্রয়োজনীয় সংযম আনুন, আর দেখুন কীভাবে ধীরে ধীরে সত্যিকারের শান্তি ও আনন্দ ফিরে আসে।

“তুমি যে সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছো, তা তোমার মধ্যেই আছে। ধন-সম্পত্তির মোহ ছেড়ে নিজের প্রকৃত সত্তাকে চিনতে পারলেই সেই সুখের সন্ধান মিলবে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top