সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য উপনিষদের বার্তা কী?

সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য উপনিষদের বার্তা কী?

আপনি কি কখনো ভেবেছেন, উপনিষদের চিরন্তন জ্ঞান আমাদের সমাজের বৈষম্য দূর করতে পারে? আমি নিজেও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি, উপনিষদ শুধু আধ্যাত্মিক জীবন নয়, সামাজিক জীবনেরও গভীর দিশা দেয়। আসুন, উপনিষদের বার্তাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখি, কীভাবে আমরা বৈষম্যহীন এক সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

উপনিষদের সারমর্ম: একতার বার্তা

উপনিষদ বলে, “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১) — এই সৃষ্টির প্রতিটি কণা ব্রহ্মের অংশ। যখন আমরা বুঝতে পারি যে, আপনি-আমি-আমরা সবাই এক সত্তার অংশ, তখন আর শ্রেণি, জাতি, বা ধনী-গরিবের পার্থক্য থাকে না। আপনি নিজে ভাবুন তো, যদি আমরা একে অপরকে ব্রহ্মের অংশ হিসেবে দেখতে শিখি, তবে কি বৈষম্যের কোনো স্থান থাকে?

আমি একবার একটি গ্রামে গিয়েছিলাম যেখানে মানুষ নিজেদের মধ্যে জাতপাত নিয়ে দ্বন্দ্ব করছিল। উপনিষদের এই বার্তাটি যখন তাদের শোনালাম, তখন তাদের মধ্যে অনেকেই উপলব্ধি করলেন, এই ভেদাভেদ কৃত্রিম এবং অপ্রয়োজনীয়।

ভোগবাদ বনাম সমবণ্টন: “ত্যাগের মাধ্যমে শান্তি”

উপনিষদে বলা হয়েছে, “ত্যাগেন ভুঞ্জীথা” (ঈশোপনিষদ ১)— ত্যাগের মাধ্যমে প্রকৃত ভোগ সম্ভব। আমাদের সমাজে ধনী-গরিবের পার্থক্য প্রধানত সম্পদের অসম বণ্টনের জন্য। কিন্তু যদি আমরা ত্যাগের নীতিকে গ্রহণ করি, তাহলে এই অসমতা দূর করা সম্ভব। আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন, যখন আপনি কারো সাথে কিছু ভাগাভাগি করেন, তখন আপনার মনে যে আনন্দ হয়, সেটি সম্পূর্ণ আপনার নিজের জন্য ভোগ করার আনন্দের চেয়েও গভীর?

একবার আমি একটি স্থানীয় বিদ্যালয়ে দেখেছিলাম, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইয়ের অভাব। আমি যাদের বই বেশি ছিল, তাদের ত্যাগের এই বার্তা শোনালাম। অবাক করা বিষয় হলো, ছাত্ররা নিজেরাই তাদের বই অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার উদ্যোগ নিল।

শিক্ষা এবং সমতা: “সর্বশিক্ষা, সর্বজনীন জ্ঞান”

উপনিষদে বলা হয়েছে, “বিদ্যা বিবেক দদাতি” — বিদ্যা মানুষের বিবেককে আলোকিত করে। বৈষম্যের অন্যতম কারণ শিক্ষার অভাব। আপনি কি জানেন, যখন শিক্ষা সর্বজনীন হয়, তখন সমাজে বৈষম্য কমে যায়? একবার আমার সাথে এক মেয়ের দেখা হয়েছিল, যে শুধুমাত্র তার পিতার আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে পড়াশোনা করতে পারছিল না। তাকে উপনিষদের শিক্ষা সম্পর্কিত ধারণাগুলো শোনালাম এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহায্যের একটি প্রচেষ্টা শুরু করলাম। সেই মেয়েটি এখন কলেজে পড়ছে এবং ভবিষ্যতে শিক্ষিকা হতে চায়।

অহংকারের বিনাশ: সমতার মূলমন্ত্র

উপনিষদে বলা হয়েছে, “অহং ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৪.১০)— আমি ব্রহ্ম। তবে এই উপলব্ধি অহংকারের জন্য নয়, বরং নিজের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সবার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য। যখন আমরা এই জ্ঞান অর্জন করি, তখন শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার আমাদের মধ্যে থাকে না। আপনি কি মনে করেন, যদি সমাজের প্রতিটি মানুষ নিজের অহংকার ত্যাগ করে, তাহলে কি বিভেদ থাকবে?

একবার আমি একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে সহযোগিতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রতিযোগীরা যখন নিজেদের অহং ত্যাগ করে একে অপরকে সাহায্য করল, তখন প্রতিযোগিতা একটি উদাহরণ হয়ে উঠল।

উপনিষদের উদাহরণ দিয়ে সামাজিক বৈষম্য দূর করা

উপনিষদের বার্তাগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা সহজ নয়, তবে সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ:

  • সমবণ্টন প্রথা প্রচলন: গ্রামের স্তরে পঞ্চায়েতগুলিকে সম্পদ বণ্টনের দায়িত্ব দেওয়া।
  • সবার জন্য শিক্ষা: গ্রামীণ এলাকায় উপনিষদ-ভিত্তিক শিক্ষার প্রসার।
  • সচেতনতা বৃদ্ধি: শহর ও গ্রামে ভেদাভেদহীনতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।

শেষ কথন: উপনিষদের দর্শন এবং আপনার ভূমিকা

উপনিষদের জ্ঞান থেকে আমি বুঝেছি, সামাজিক বৈষম্য দূর করা শুধুমাত্র নীতি নয়, এটি আমাদের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক দায়িত্ব। আমি আপনাকে প্রশ্ন করব: আপনি কি ব্রহ্মের এই একতার বাণীকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করবেন? যদি হ্যাঁ, তাহলে আমাদের চারপাশে পরিবর্তন ঘটাতে আপনিও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top