সনাতন ধর্মের মূল দর্শন হলো সমস্ত সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা ও সাম্যবোধ। এই ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে প্রতিটি জীবাত্মা ঈশ্বরের অংশ এবং প্রত্যেকের জীবনধারণের সমান অধিকার রয়েছে। এই মৌলিক ধারণা উপনিষদে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। উপনিষদ মানে ‘জ্ঞান লাভের জন্য গুরু বা জ্ঞানীর নিকট বসা’। এটি বৈদিক জ্ঞান ও দর্শনের শেষ পর্ব, যেখানে মানবজীবনের গভীর তত্ত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
অধিকার এবং সমতা: উপনিষদের দৃষ্টিতে
উপনিষদ বারবার জোর দিয়ে বলে যে, বসুধৈব কুটুম্বকম—সমস্ত পৃথিবী এক পরিবার। এই বাণী আমাদের শেখায়, মানবমণ্ডলীর প্রতিটি ব্যক্তি সমান। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা অবস্থানের ভিত্তিতে কোনো পার্থক্য করা সনাতন ধর্মে সমর্থন পায় না।
উপনিষদে বলা হয়েছে:
“ईशावास्यमिदं सर्वं यत्किञ्च जगत्यां जगत्।
तेन त्यक्तेन भुञ्जीथा: मा गृध: कस्यस्विद्धनम्।।”
(ঈশোপনিষদ ১.১)
এর অর্থ হলো, এই জগৎ ও সমস্ত সম্পদ ঈশ্বর দ্বারা পরিব্যাপ্ত। প্রতিটি ব্যক্তি তার প্রয়োজনমতো গ্রহণ করবে, কিন্তু লোভ বা স্বার্থপরতা থেকে বিরত থাকবে। এই শ্লোকটি সরাসরি মানবজীবনের অধিকার ও দায়িত্বের কথাই বলে।
স্বাধীনতার অধিকার এবং আত্মসাক্ষাতের পথে
উপনিষদে আরও বলা হয়েছে যে, প্রতিটি মানুষ মুক্তির অধিকারী। মায়া, অজ্ঞানতা এবং আত্মার অজ্ঞতা থেকে মুক্তি পাওয়া প্রত্যেকের জন্মগত অধিকার। মুণ্ডক উপনিষদ-এ উল্লেখ আছে:
“सत्यमेव जयते नानृतं। सत्येन पन्था विततो देवयानः।।”
(মুণ্ডক উপনিষদ ৩.১.৬)
এখানে বলা হয়েছে, সত্যের পথেই জয়, মিথ্যার দ্বারা নয়। প্রত্যেকের সত্য ও ধর্ম পালন করার অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে।
উদাহরণ: সনাতন ধর্মের জীবনঘনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি
সনাতন ধর্মের ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে সাধারণ মানুষের অধিকার সুরক্ষিত হয়েছে।
১. রাজা হরিশচন্দ্রের কাহিনি আমাদের শেখায়, সত্য এবং ন্যায়ের প্রতি অবিচল থেকে কীভাবে একজন ব্যক্তি তার অধিকার ও মর্যাদা বজায় রাখতে পারে।
২. মহাভারতে বিদুরের পরামর্শ কেবল রাজা নয়, সাধারণ মানুষের প্রতি ন্যায় এবং সম্মান প্রদর্শনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। বিদুর নীতিতে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি অপরের অধিকারকে সম্মান করে, সে নিজেই সম্মানিত হয়।”
৩. ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গীতার বাণী-তে বলেছেন:
“समोऽहं सर्वभूतेषु न मे द्वेष्योऽस्ति न प्रियः।।”
(ভগবদ্গীতা ৯.২৯)
ভগবান এখানে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে তিনি সমস্ত জীবের প্রতি সমান। এই শিক্ষা আমাদের শেখায়, আমরা সবাই এক।
উপনিষদে দায়িত্ব ও অধিকার: একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনধারা
উপনিষদ শুধু অধিকার নয়, দায়িত্বেরও কথা বলে। প্রতিটি অধিকার একটি দায়িত্বের সাথে যুক্ত। আপনি যদি প্রকৃতি থেকে কিছু গ্রহণ করেন, তবে প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ব পালন করাও আপনার কর্তব্য।
সনাতন দর্শনের চিরন্তন বাণী
উপনিষদ আমাদের দেখায় যে, জীবনের সঠিক পথ হলো নিজ অধিকারকে সঠিকভাবে চর্চা করা এবং অপরের অধিকারকে সম্মান করা। এটি শুধুমাত্র একটি ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের বিষয় নয়, এটি সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি শিক্ষা। এই শিক্ষার মাধ্যমে আমরা সুখী ও সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
পরিশেষে, আমাদের সনাতন ধর্মের মূল বার্তা হলো:
“सर्वे भवन्तु सुखिनः सर्वे सन्तु निरामयाः।।”
সবাই সুখী হোক, সবাই শান্তিতে থাকুক। এই চেতনাই আমাদের অধিকার ও দায়িত্বের সত্য রূপ।