জীবনযাত্রার জটিলতা থেকে মুক্তি খুঁজতে গেলে, আমাদের প্রত্যেককে একবার ভেবে দেখা উচিত—সাধারণ ও মিতব্যয়ী জীবনযাপন কি সত্যিই সুখের চাবিকাঠি হতে পারে? আমি বিশ্বাস করি, এটি কেবলমাত্র ব্যক্তিগত শান্তি নয়, বরং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথও দেখায়। উপনিষদে বারবার জ্ঞানের আলোকে জীবনকে সহজ ও মিতব্যয়ী রাখার কথা বলা হয়েছে। আসুন, আমরা এই দর্শনের অন্তর্নিহিত দিকগুলো বুঝি এবং প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দিয়ে দেখি এটি আমাদের জীবনে কীভাবে কার্যকর হতে পারে।
উপনিষদের নির্দেশনা
উপনিষদ বলে: “সত্যমেব জয়তে নানৃতং”—সত্যই জয়ী হয়, মিথ্যা নয়।
এই সত্য জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। আমরা যদি সাধারণ ও মিতব্যয়ী জীবনযাপনে মনোনিবেশ করি, তা হলে মিথ্যা অহংকার বা অপ্রয়োজনীয় ভোগবিলাস থেকে দূরে থাকা সম্ভব।
“তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ” (ঈশোপনিষদ) এর অর্থ হলো, ত্যাগের মাধ্যমে আনন্দ পাওয়া।
আপনি যখন আপনার চাহিদাগুলোকে সীমাবদ্ধ করবেন, তখন প্রকৃত আনন্দ অনুভব করতে পারবেন।
একটি সহজ উদাহরণ দিই। আমি যখন আমার জীবনে অহেতুক প্রযুক্তির ব্যবহার কমিয়েছি, তখনই বুঝতে পেরেছি কতটা সময় আমি অপচয় করছিলাম। মিতব্যয়িতা শুধু অর্থসাশ্রয় নয়, সময় এবং মানসিক শান্তিরও রক্ষা করে।
আমাদের চারপাশে সাধারণ জীবনযাপনের উদাহরণ
আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, গ্রামে যারা প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করে, তাদের জীবন শহরের চেয়ে অনেকটা শান্তিপূর্ণ মনে হয় কেন? কারণ তারা তাদের প্রয়োজনকে কমিয়ে জীবনের সহজ সৌন্দর্য উপভোগ করে। আমি এমন এক বন্ধুর কথা জানি, যিনি চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়ে কৃষিকাজ শুরু করেছেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি যত কম ভোগ করছি, তত বেশি আনন্দ পাচ্ছি।”
আপনিও যদি মিতব্যয়ী জীবনযাপনের দিকে মনোযোগ দেন, আপনি দেখবেন যে আপনার চারপাশে অনেক কিছুই অপ্রয়োজনীয়। যেমন, অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা, অতি আধুনিক জীবনের প্রতি আকর্ষণ—এসব শুধু মানসিক চাপই বাড়ায়।
“আত্মনং বিদ্ধি”(বৃহদারণ্যক উপনিষদ)—অর্থাৎ নিজেকে জানুন।
এই জ্ঞান আমাদের শেখায়, প্রকৃত প্রয়োজন এবং চাহিদার মধ্যে ফারাক কী।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধি
আমি নিজে যখন সাধারণ জীবনযাপনের চেষ্টা করেছি, তখন দেখেছি আমার মানসিক চাপ অনেকটা কমে গেছে। একবার আমি মাসের শেষে হিসাব করছিলাম, কত টাকা আমি অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ব্যয় করেছি। এই উপলব্ধি থেকে আমি মিতব্যয়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এর ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকার অভ্যাস আমাকে সুখী করেছে।
উপনিষদে আরও একটি চমৎকার কথা বলা হয়েছে: “ন কামে নিষ্কামো ভব”—কামনাহীন হওয়ার চেষ্টা করুন।
আপনার মনে হতে পারে, এটি তো কঠিন! কিন্তু, আপনি যদি ধীরে ধীরে চেষ্টা করেন, দেখবেন যে আপনার অহেতুক আকাঙ্ক্ষাগুলো স্বাভাবিকভাবেই কমে যাচ্ছে।
পরিবেশের প্রতি দায়িত্ব
মিতব্যয়ী জীবনযাপন শুধু আমাদের নিজের নয়, পরিবেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন কম ব্যবহার করি, তখন প্রাকৃতিক সম্পদও সংরক্ষিত হয়।
উপনিষদে বলা হয়েছে: “মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিব্যাঃ”—পৃথিবী আমাদের মা। তার যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
আপনি কি জানেন, উন্নত দেশগুলোতে মিতব্যয়ী জীবনযাপনের জন্য “মিনিমালিজম” একটি জনপ্রিয় ধারণা হয়ে উঠেছে? এটি আসলে আমাদের শাশ্বত ভারতীয় দর্শনেরই একটি প্রতিফলন। কম ভোগ করুন, এবং আরও ভালোভাবে বাঁচুন।
আপনার জন্য কিছু প্রাসঙ্গিক পরামর্শ
১. আপনার দৈনন্দিন জীবনে খরচের হিসাব রাখুন।
২. অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা বন্ধ করুন।
৩. যা আছে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন।
৪. আপনার সময় এবং সম্পদ এমন জায়গায় ব্যয় করুন, যা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।
৫. প্রকৃতির কাছাকাছি সময় কাটান।
উপনিষদে বলা হয়েছে: “ধনং ম অভ্যর্থয় স্বধর্মমুপাস”—অর্থের পিছনে না ছুটে, নিজের ধর্ম বা কর্তব্য পালন করুন।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জীবনের প্রকৃত অর্থ সম্পদে নয়, বরং আত্মার পরিপূর্ণতায়।
শেষ কথা
সাধারণ ও মিতব্যয়ী জীবনযাপনের মাধ্যমে আপনি জীবনের প্রকৃত স্বাদ পেতে পারেন। আপনি যদি সত্যিই নিজের জীবনে পরিবর্তন আনতে চান, তবে এই দর্শনটি অনুসরণ করার চেষ্টা করুন।
উপনিষদের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করি: “অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়”—আমাকে অজ্ঞান থেকে জ্ঞানের পথে, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চল।
আপনার কী মনে হয়, আমরা কি এই সহজ কিন্তু গভীর জীবনদর্শন থেকে আরও কিছু শিখতে পারি? আপনি কি প্রস্তুত জীবনের জটিলতাগুলো কাটিয়ে সরলতার পথে হাঁটতে?