সম্পদের সঠিক বণ্টন সম্পর্কে উপনিষদ কী বলে?

সম্পদের সঠিক বণ্টন সম্পর্কে উপনিষদ কী বলে?

উপনিষদ শুধুমাত্র জ্ঞানচর্চার নয়, জীবনের সঠিক পথনির্দেশনার এক অতুলনীয় গ্রন্থ। এতে আমরা আত্মার জ্ঞান, পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মতা, এবং আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে দিকনির্দেশনা পাই। আধুনিক জীবনে, যখন সম্পদ আর বিত্ত নিয়ে প্রতিনিয়ত টানাপোড়েন চলছে, তখন উপনিষদের শিক্ষা আরও প্রাসঙ্গিক। “সম্পদ” শব্দটির অর্থ এখানে শুধু অর্থ নয়, বরং জ্ঞান, সামর্থ্য এবং ভোগ্যবস্তুও অন্তর্ভুক্ত। প্রশ্ন হলো, কীভাবে সম্পদের সঠিক বণ্টন করলে জীবনে শান্তি এবং উন্নতি সম্ভব?

সম্পদের প্রকৃত অর্থ কী?

উপনিষদে বলা হয়েছে, “ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত।”
অর্থাৎ, এই সমগ্র বিশ্ব এবং বিশ্বে যা কিছু আছে, তা সবই ঈশ্বরের আবাস। সবই তাঁর সৃষ্টি, এবং সবই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। এই কথাটি মনে রাখলে আমরা বুঝতে পারি, সম্পদ আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এটি প্রকৃতির এবং ঈশ্বরের অর্পণ। অতএব, যদি আমি বা তুমি আমাদের প্রাপ্ত সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করি এবং তা অন্যদের মধ্যে বণ্টন করি, তবেই প্রকৃত শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব।

উপনিষদের সম্পদ-বণ্টনের তিনটি মূল শিক্ষা

১. “ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ” – ঈশোপনিষদ

ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে:
“ত্যেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা।”
অর্থাৎ, ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ করো। এই ত্যাগ মানে “সব ছেড়ে দাও” এমন নয়, বরং অন্যদের ভাগ দাও এবং অহংকার ছেড়ে দাও। একজন মানুষের যা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি যদি জমিয়ে রাখে, সেটি সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে। এই বাণী আমাদের শেখায়, যতটা প্রয়োজন ততটাই গ্রহণ করো এবং বাকিটা সমাজের কল্যাণে দান করো।

উদাহরণ হিসেবে ধরো, তুমি একজন কৃষক। তোমার প্রচুর শস্য উৎপাদন হয়েছে। যদি তুমি সেটিকে গুদামজাত করো এবং বাজারে বিক্রি না করো, তখন সমাজে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু যদি তুমি এক অংশ দান করো বা ন্যায্য মূল্যে শস্য বিক্রি করো, তখন সমাজের সকলের কল্যাণ হবে। আর এভাবেই সম্পদের সঠিক বণ্টন সম্ভব।

২. “অপরের কল্যাণে নিজের সম্পদ ব্যবহার”

বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে:
“সর্বং পরার্থং সমাহিতং।”
অর্থাৎ, প্রকৃত সম্পদ সে-ই অর্জন করে, যে তার সম্পদ অপরের কল্যাণে ব্যবহার করে।
আমরা দেখেছি, পৃথিবীতে অনেক মহান ব্যক্তি সম্পদের সঠিক বণ্টন করেছেন। এক উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি নিজের জমি এবং অর্থ দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন যাতে সমাজের সকল মানুষ শিক্ষালাভ করতে পারে। এটি উপনিষদের “সর্বং পরার্থং” নীতিরই উদাহরণ।

৩. “আত্মসংযম এবং লোভের পরিহার”

কঠোপনিষদে একটি বিখ্যাত শ্লোক আছে:
“যদ্‌ নেৎহ ঞাতং নিৎযং অল্পম।”
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি সীমার মধ্যে থাকে এবং লোভ সংবরণ করে, সেই প্রকৃত সুখী।
লোভ হল সেই আগুন, যা কখনো নিভে না। তুমি যত সম্পদই অর্জন করো না কেন, যদি তোমার মধ্যে লোভ থাকে, তা তোমাকে কখনো শান্তি দেবে না। আমরা অনেক ধনী ব্যক্তিকে দেখি, যারা অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েও মানসিকভাবে অশান্তিতে ভোগেন। কারণ, তারা সম্পদকে নিজের বলে মনে করেন এবং অন্যদের জন্য কিছু করার চিন্তা করেন না।

এর একটি বাস্তব উদাহরণ হলো মহাত্মা গান্ধী। তিনি আত্মসংযমের মাধ্যমে জীবন যাপন করতেন এবং তাঁর সমস্ত শক্তি ও সম্পদ দেশ ও সমাজের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। গান্ধীজির জীবন উপনিষদের সম্পদ-বণ্টনের শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলন।

আধুনিক সমাজে সম্পদের সঠিক বণ্টন কেন প্রয়োজন?

আজকের সমাজে আমরা যে বৈষম্য দেখতে পাচ্ছি, তা মূলত সম্পদের সঠিক বণ্টন না হওয়ার ফল। একদিকে কিছু মানুষ অঢেল সম্পদের মালিক, অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। উপনিষদের শিক্ষা অনুসরণ করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

  •  বিত্তবানরা দানের মাধ্যমে সমাজের কল্যাণে এগিয়ে এলে অনেক দরিদ্র মানুষ জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
  •  অতিরিক্ত ভোগবিলাস পরিহার করে আমরা পরিবেশের উপর চাপ কমাতে পারি।
  •  “ত্যাগে সুখ” এবং “পরার্থে কল্যাণ” নীতিকে জীবনে গ্রহণ করলে ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ই শান্তি পাবে।

সম্পদের সঠিক বণ্টনের কিছু বাস্তব উদাহরণ

  •  অমর্ত্য সেনের অর্থনীতি: অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন “সামাজিক ন্যায়” এবং “অধিকার ভিত্তিক উন্নয়ন”-এর কথা বলেছেন, যা উপনিষদের নীতিরই প্রতিফলন।
  •  মা তেরেসার দানশীলতা: নিজের জীবনকে তিনি গরিব এবং অসহায় মানুষের সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন।
  •  আধুনিক CSR উদ্যোগ: অনেক বড় বড় কোম্পানি আজ তাদের লাভের একটা অংশ সমাজের কল্যাণে ব্যয় করে। এটি সম্পদের সঠিক বণ্টনের একটি আধুনিক রূপ।

জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?

উপনিষদের শিক্ষা আমাদের বলে, সম্পদের সঠিক বণ্টন শুধু দায়িত্ব নয়, এটি একধরনের পূণ্য। আমরা যদি নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর অন্যদের ভাগ দিই, তাতে সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবেই।

ভেবে দেখো, যদি প্রকৃতির মতো সবাই সমানভাবে নিজের সম্পদ বিলিয়ে দেয়, তাহলে কি পৃথিবীতে কেউ অভুক্ত থাকবে? আমরা যদি প্রতিদিন কিছুটা ত্যাগ করি, তাহলে কি আমাদের জীবন আরও সুন্দর ও সমৃদ্ধ হবে না?

তাহলে আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করো—তুমি যা পেয়েছো, তা থেকে অন্যদেরও কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবে। এই ত্যাগই তোমাকে প্রকৃত সুখ এনে দেবে। আর মনে রেখো, “ত্যাগই প্রকৃত ভোগ।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top