সন্তানের প্রতি পিতামাতার ভালোবাসা কীভাবে প্রকাশ করা উচিত?

সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে পিতামাতার দায়িত্ব শুধু তাদের চাহিদা পূরণ করা নয়, বরং তাদের জীবনের প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া। কিন্তু কীভাবে এই দায়িত্ব পালন করলে সন্তানের মনে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সঠিক পথের অনুপ্রেরণা জাগে? উপনিষদে এই বিষয়ে গভীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করা হয়েছে, যা আজকের সমাজে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

পিতামাতার দায়িত্ব: একটি উপনিষদীয় দৃষ্টিভঙ্গি

আপনাদের মনে হতে পারে, উপনিষদে কি আদৌ পিতামাতার দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে? হ্যাঁ, বলা হয়েছে। ছন্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে:

“মাতৃ দেবো ভব। পিতৃ দেবো ভব। আচার্য দেবো ভব।”

অর্থাৎ, মাতা-পিতা সন্তানের কাছে দেবতুল্য। তবে তাদের এই স্থান পেতে হলে, তাদের চরিত্রে আদর্শ ও কর্মে সত্য থাকতে হবে। সন্তানকে ভালোবাসা মানে শুধুমাত্র তাদের সুখসুবিধা নিশ্চিত করা নয়, বরং তাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য বুঝতে সাহায্য করা।

ভালোবাসার প্রকৃত রূপ: তিনটি উদাহরণ

আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা কীভাবে সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায়, তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় থাকেন। এখানে আমি তিনটি উদাহরণ শেয়ার করছি:

  •  মনের শক্তি বাড়ানোর উপায় শেখানো: একটি সময় ছিল যখন আমার সন্তান পরীক্ষার ভয়ে অসহায় বোধ করত। আমি তাকে কঠোরভাবে সমালোচনা না করে উপনিষদের এই কথা স্মরণ করালাম:

“সত্যমেব জয়তে।”

অর্থাৎ, সত্যই জয়লাভ করে। আমি তাকে বলেছিলাম, পরিশ্রম আর সত্যবাদিতার পথে চললে কখনো হেরে যাবে না। তার মনোবল বেড়ে গেল, এবং সে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করল।

  •  ক্ষমা করার শিক্ষা: একবার আমার সন্তান ভুল করে একটি বন্ধুকে কষ্ট দিয়েছিল। আমি তাকে কঠোরভাবে দোষারোপ না করে বুঝিয়ে বলেছিলাম, ক্ষমার মধ্যে যে শান্তি আছে, তা অপরিসীম। কেননা ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে:

“যঃ সর্বাণি ভূতানি আত্মন্ এবানুপশ্যতি।”

অর্থাৎ, যিনি সব প্রাণীতে নিজের আত্মার অস্তিত্ব অনুভব করেন, তিনি সকলকে ক্ষমা করতে সক্ষম। এই শিক্ষা তার চরিত্র গঠনে সাহায্য করেছে।

  • সৃজনশীলতা বিকাশে সাহায্য: আমার সন্তান ছোটবেলায় ছবি আঁকতে ভালোবাসত। পড়াশোনার চাপের কারণে একসময় সে এই অভ্যাস হারিয়ে ফেলতে বসেছিল। আমি তাকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলাম:

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম।”

অর্থাৎ, সবকিছুই ব্রহ্ম। তার সৃজনশীলতাই ঈশ্বরের এক বিশেষ দান। এই কথা শুনে সে আবার আঁকতে শুরু করল এবং নিজের আনন্দ খুঁজে পেল।

শাসন ও ভালোবাসার সঠিক সমন্বয়

আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, শাসন আর ভালোবাসার মধ্যে কীভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তরও আমরা উপনিষদ থেকে পাই। “তৈত্তিরীয় উপনিষদ” বলে:

“শিক্ষা বালানাং প্রিয়ম।”

অর্থাৎ, শিক্ষা তখনই কার্যকর হয় যখন তা ভালোবাসার সাথে দেওয়া হয়। সন্তানের ভুল হলে তাকে শুধরে দিন, কিন্তু কখনো তাকে দমিয়ে রাখবেন না। শাসনের মাধ্যমে ভালোবাসার প্রকাশ করতে হবে।

আধুনিক যুগে উপনিষদের প্রাসঙ্গিকতা

আজকের যুগে পিতামাতারা প্রায়ই সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগের অভাব বোধ করেন। প্রযুক্তির যুগে সন্তানেরা নিজেদের ফোন বা কম্পিউটারে মগ্ন থাকে। এই ক্ষেত্রে উপনিষদের শিক্ষাগুলো কীভাবে প্রাসঙ্গিক?

প্রথমত, সন্তানের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। তাদের জন্য সময় দিন, তাদের শখ ও চিন্তাভাবনা বোঝার চেষ্টা করুন। এই প্রসঙ্গে, “অথর্ববেদ” বলে:

“সঙ্গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং।”

অর্থাৎ, একত্রে চলুন, একত্রে কথা বলুন।

দ্বিতীয়ত, তাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিন। শুধু একাডেমিক সাফল্যই জীবনের সবকিছু নয়। উপনিষদ বলে:

“বিদ্যা বিভক্তি।”

অর্থাৎ, প্রকৃত শিক্ষা হলো সেই শিক্ষা যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে লাগে।

সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্মাণ

আপনি যদি সন্তানকে সত্যিকারের ভালোবাসেন, তবে তার ভবিষ্যৎ নির্মাণে সাহায্য করুন। তার শক্তি ও দুর্বলতাগুলো বুঝে তাকে সঠিক পথ দেখান। উপনিষদের ভাষায়:

“আত্মানং বিদ্ধি।”

অর্থাৎ, নিজেকে জানো।

আপনার সন্তান যখন নিজের মনের গভীরতা বুঝতে শিখবে, তখনই সে প্রকৃত সাফল্যের দিকে এগোবে।

উপনিষদের আলোয় জীবন

সন্তানকে ভালোবাসার মানে তাকে নিজের মতো করে গড়ে তোলা নয়, বরং তাকে তার নিজের পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করা। উপনিষদের শিক্ষা আপনাকে এই কাজে পথ দেখাতে পারে। আপনার সন্তানের প্রতি ভালোবাসা কি তাকে জীবনের সঠিক দিশা দিতে পারছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজুন নিজের হৃদয়ে।

আপনার সন্তানকে ভালোবাসার এই যাত্রা আপনার নিজের আত্মার বিকাশও ঘটাবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top