আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, সন্তানদের প্রতি আমাদের প্রকৃত দায়িত্ব কী? আমরা অনেক সময় তাদের খাওয়ানো, পড়াশোনা করানো, এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার কথা বলি। কিন্তু কীভাবে আমরা তাদের জীবনকে প্রকৃত অর্থে সমৃদ্ধ করতে পারি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমি উপনিষদে ফিরে যাই। উপনিষদ আমাদের এমন কিছু জীবন-ঘনিষ্ঠ জ্ঞান দেয় যা সন্তানদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে গভীরভাবে আলোকপাত করে।
“মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব।” – এটি তৈত্তিরীয় উপনিষদের এক মহৎ শিক্ষা। এখানে শুধু সন্তানের প্রতি নয়, পিতামাতার দায়িত্বকেও এক উচ্চস্থানে তুলে ধরা হয়েছে। আসুন দেখি, উপনিষদ কীভাবে আমাদের এই দায়িত্ব সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়।
সন্তানের মানসিক বিকাশের যত্ন নেওয়া
আপনি কি জানেন, একটি সন্তানের মানসিক বিকাশ তার প্রাথমিক বছরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? উপনিষদ বলে, “সর্বং ব্রম্মময়ম।” – অর্থাৎ, প্রতিটি শিশুর মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের সম্ভাবনা বিদ্যমান। আমাদের দায়িত্ব তাদের সেই সম্ভাবনাকে উন্মোচন করতে সাহায্য করা।
যেমন, আমি আমার নিজের ছেলের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি, যখনই আমি তাকে কোনো নতুন কিছু শেখানোর চেষ্টা করেছি, তাকে প্রশ্ন করতে দিয়েছি। তার কৌতূহলকে দমন না করে তাকে উৎসাহিত করেছি। তার জিজ্ঞাসার উত্তরে কখনো বিরক্ত না হয়ে, আমি বরং তার সাথে বসে চিন্তা করেছি। এর ফলে, সে শুধু জ্ঞান অর্জন করেনি, বরং আত্মবিশ্বাসও তৈরি হয়েছে।
আপনার সন্তানের প্রশ্নের উত্তর দিন। তাদের ভাবনার প্রতি সম্মান দেখান। এভাবেই তারা আত্মবিকাশের পথে এগিয়ে যাবে।
নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব
উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে, “সত্যং বদ, ধর্মং চর।” – সত্য বলো, এবং ধর্মের পথে চল। সন্তানদের প্রতি আমাদের অন্যতম বড় দায়িত্ব হলো তাদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা।
আমার এক বন্ধুর কাহিনি এখানে বলি। তিনি তার ছেলেকে খুব ছোট বয়স থেকেই গল্পের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা দিয়েছেন। একদিন তার ছেলে খেলতে গিয়ে অন্য এক বন্ধুর খেলনা ভেঙে ফেলেছিল। সে সঙ্গে সঙ্গে এসে তা স্বীকার করেছিল এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। এটি তার নৈতিক শিক্ষা এবং সত্যবাদিতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
আপনি গল্প, উদাহরণ, এবং নিজের কাজের মাধ্যমে সন্তানকে সত্যবাদিতা, দয়া, এবং ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দিতে পারেন। এতে তারা ভবিষ্যতে নৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
আত্মচেতনার বিকাশ
উপনিষদ বলে, “আত্মা বৈ আরেয় দ্রষ্টব্য।” অর্থাৎ, আত্মাকে জানাই জীবনের মূল উদ্দেশ্য। সন্তানদের আত্মচেতনার শিক্ষা দেওয়া আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তাদের শেখান, তারা কেবল শারীরিক সত্তা নয়, তাদের আত্মা আরও বৃহত্তর কিছু।
যেমন, আমি আমার মেয়েকে ধ্যানের অভ্যাস করিয়েছি। প্রাথমিকভাবে এটি তার জন্য কঠিন ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সে এটি উপভোগ করতে শিখেছে। এখন, যখন সে কোনো বিষয়ে চিন্তিত হয়, তখন সে শান্ত থাকার জন্য ধ্যান করে।
আপনারাও সন্তানকে ধ্যানের মাধ্যমে তাদের চিন্তাগুলো সংহত করতে সাহায্য করতে পারেন। এতে তাদের মানসিক শান্তি বাড়বে।
দায়িত্বশীল জীবনযাপনের শিক্ষা
উপনিষদে বলা হয়েছে, “তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ।” – সংযমের মাধ্যমে জীবনকে ভোগ করো। এই শিক্ষা আমাদের সন্তানদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্বশীলতার শিক্ষা দিতে সাহায্য করে।
আমার এক আত্মীয় তার সন্তানকে প্রতিমাসে তার সঞ্চয় এবং ব্যয় লিখে রাখতে বলেন। এর মাধ্যমে সে বুঝতে শিখেছে, কীভাবে অর্থ সঞ্চয় করতে হয় এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ এড়িয়ে চলতে হয়। এতে সে ভবিষ্যতে আরও সুসংগঠিত এবং দায়িত্বশীল মানুষ হবে।
প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ব
“প্রকৃতিঃ সত্যং।” – প্রকৃতিই সত্য। আমাদের সন্তানদের শিখাতে হবে, তারা প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল। এটি কেবল তাদের নয়, পুরো পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আমি আমার সন্তানকে গাছ লাগাতে শেখাই। প্রতি বছর আমরা একটি নতুন গাছ লাগাই এবং সেটি পরিচর্যা করি। এটি তার মধ্যে প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ববোধ তৈরি করেছে। আপনারাও এই ধরনের ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে পারেন।
সমাপ্তি
উপনিষদের শিক্ষা অনুসারে সন্তানদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব শুধুমাত্র তাদের শারীরিক বা একাডেমিক বিকাশে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের দায়িত্ব তাদের নৈতিক শিক্ষা, আত্মচেতনা, এবং সামাজিক দায়িত্বশীলতার মতো দিকগুলোতেও সাহায্য করা।
শেষে একটি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই: আমরা কি আমাদের সন্তানদের শুধু এই পৃথিবীর জন্য প্রস্তুত করছি, নাকি তাদের এমনভাবে গড়ে তুলছি, যাতে তারা আত্মজ্ঞান লাভের পথে এগিয়ে যেতে পারে? উপনিষদের এই শিক্ষাগুলোই হয়তো সেই পথ দেখাতে পারে।