সনাতন ধর্মে “সত্য” শুধুমাত্র একটি ধারণা নয়, এটি জীবনের মূলভিত্তি। উপনিষদ, যাকে আমরা ভেদের জ্ঞানভাণ্ডার বলি, সত্যকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছে। “সত্যমেব জয়তে”—এই শব্দগুচ্ছ আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, সত্য সর্বদাই বিজয়ী হয়। আসুন, সত্যের গুরুত্ব এবং তা আমাদের জীবনে কিভাবে প্রভাব ফেলে, তা উপনিষদ থেকে কিছু গল্প ও উপদেশের মাধ্যমে বুঝি।
সত্যের ব্যাখ্যা উপনিষদে
উপনিষদে সত্যকে “ব্রহ্ম” বা পরমাত্মার সমার্থক ধরা হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদ বলেছে,
“সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম।”
অর্থাৎ, সত্য, জ্ঞান এবং অনন্ত এই তিনটি ব্রহ্মের প্রকৃতি। সত্য আমাদের আত্মার মুক্তির পথ দেখায়। মিথ্যা বা অসত্য আমাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাই, সত্যের অনুসরণ করা মানে জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া।
সত্যের উদাহরণ: হরিশচন্দ্রের কাহিনি
সনাতন ধর্মের এক মহৎ উদাহরণ হল রাজা হরিশচন্দ্র। তিনি সত্যের জন্য নিজের রাজ্য, সম্পদ এবং পরিবার সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। বিশ্বামিত্র ঋষির পরীক্ষা দেওয়ার সময়, তিনি কঠোর দুঃখ-দুর্দশা সত্ত্বেও মিথ্যার পথে যাননি। পরবর্তীতে, তাঁর এই সত্যনিষ্ঠার জন্য দেবতারা খুশি হয়ে তাঁকে আবার সবকিছু ফিরিয়ে দেন।
এই কাহিনি আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, জীবনে যেকোনো পরিস্থিতি আসুক না কেন, সত্যের পথ ত্যাগ করা উচিত নয়। কারণ সত্যই একমাত্র শক্তি যা আমাদের প্রকৃত সুখ দিতে পারে।
সত্যের শক্তি: ঋষিদের শিক্ষা
আমাদের ঋষিমুনিরা সর্বদাই সত্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। একবার ঋষি বাল্মীকি তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন,
“সত্যই ব্রহ্মের প্রকাশ। মিথ্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে সত্যে অবিচল থাকতে হবে।”
এমনকি উপনিষদে উল্লেখিত শাস্ত্রীয় মন্ত্র ও উপদেশগুলো সত্যের উপরে ভিত্তি করে গঠিত।
আধুনিক জীবনে সত্যের প্রাসঙ্গিকতা
আজকের যুগে সত্যের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সত্যের চর্চা আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। যখন আমরা সত্য বলি বা মেনে চলি, তখন অন্যরা আমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়।
আপনারা অনেক সময় দেখতে পাবেন, মিথ্যা সাময়িকভাবে সুখ দিতে পারে, কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে অশান্তি এবং কষ্ট নিয়ে আসে। অন্যদিকে, সত্য কখনো কখনো কঠিন মনে হতে পারে, তবে তা সবসময় আমাদের শান্তি এবং আনন্দ দেয়।
সত্যের পথে চলা: উপনিষদের নির্দেশনা
উপনিষদে বলা হয়েছে,
“সত্যং বধ, ধর্মং চর।”
অর্থাৎ, সত্য বলুন এবং ধর্মের পথে চলুন। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে প্রাসঙ্গিক। সত্যের সাথে ধর্মের মেলবন্ধন আমাদের জীবনের পূর্ণতা এনে দেয়।
সত্য, আমাদের আধ্যাত্মিক আলো
সত্য শুধু একটি নৈতিক গুণ নয়, এটি সনাতন ধর্মের হৃদস্পন্দন। উপনিষদের প্রতিটি শব্দে সত্যের চেতনা স্পষ্ট। আপনি যদি সত্যনিষ্ঠ হন, তবে আপনি সনাতন ধর্মের মূল স্রোতে প্রবাহিত হচ্ছেন। আসুন, সত্যকে আলিঙ্গন করি এবং আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তা চর্চা করি।
“সত্যমেব জয়তে”—এই মন্ত্রই হোক আমাদের জীবনের দীপশিখা।