লোভ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী?

লোভ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী?

আমাদের সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষাগুলোর একটি হল মনকে স্থিতি ও শুদ্ধতার দিকে পরিচালিত করা। লোভ, যা মানুষের মনের এক অশান্তি ও অস্থিরতার মূল কারণ, আমাদের ধর্মে তাকে এক গভীর অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপনিষদে বলা হয়েছে, লোভ আমাদের আত্মাকে আচ্ছন্ন করে এবং প্রকৃত জ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান থেকে আমাদের বিচ্যুত করে। তাই, উপনিষদে লোভ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বেশ কিছু দার্শনিক ও ব্যবহারিক দিশা দেখানো হয়েছে। আসুন, সেই দিশাগুলো নিয়ে আলোচনা করি।

লোভ কীভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে?

লোভের প্রভাব বোঝার জন্য আমরা “কঠোপনিষদ”-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশ্লেষণ করতে পারি। সেখানে বলা হয়েছে:
“যে ব্যক্তি পৃথিবীর সমস্ত বস্তু কামনা করে, সে নিজেই তার কামনার দাস হয়ে পড়ে।”
এই লোভ আমাদের মনকে দুর্বল করে তোলে। আমাদের অল্পে তৃপ্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব করে দেয়। ফলস্বরূপ, আমরা ক্রমাগত অশান্তি ও ক্লান্তির শিকার হই।

লোভ থেকে মুক্তির প্রথম ধাপ: জ্ঞানের আলো

উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে যে, “অজ্ঞানই সকল দুঃখের মূল”। তাই লোভ থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন জ্ঞানের আলোয় নিজেদের আলোকিত করা। ব্রহ্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, এই পৃথিবীর সমস্ত বস্তুই ক্ষণস্থায়ী এবং অনিত্য। “মুন্ডকোপনিষদ”-এ বলা হয়েছে:
“ন বিন্যা ব্রহ্ম লাভ্যতে” – অর্থাৎ, প্রকৃত জ্ঞান ছাড়া ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা যায় না।

আপনার যদি মনে হয় সম্পদ, ক্ষমতা বা অন্য বস্তুগত প্রাপ্তি আপনাকে সুখ দেবে, তবে আপনি ভুল পথে হাঁটছেন। এগুলো কখনোই স্থায়ী সুখ এনে দিতে পারে না। তাই জ্ঞান অর্জন করুন এবং বুঝুন, প্রকৃত শান্তি ভিতরে লুকিয়ে আছে।

অল্পে তুষ্ট থাকার অভ্যাস

উপনিষদে “সন্তোষ” বা তৃপ্তিকে সবচেয়ে বড় সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে:
“তৈন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ”
অর্থাৎ, নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ করো এবং বাকিটা ত্যাগ করো। প্রকৃতিতে যা কিছু আছে, তা সবার জন্য। তাই অন্যের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য লোভ করা উচিত নয়।

একটি উদাহরণ দিয়ে বলি। মহর্ষি দ্রোণাচার্যের জীবনে আমরা দেখেছি যে, তিনি সামান্য ভোজনে তুষ্ট থেকে নিজের জীবন অতিবাহিত করেছেন। তাঁর তপস্যার ফলে তিনি অমর জ্ঞান লাভ করেছিলেন।

ভক্তি ও ঈশ্বরচিন্তা

লোভ থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হল ভক্তি ও ঈশ্বরচিন্তা। “ভগবদ গীতা”-য় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:
“যৎ করোষি যৎ জুহোষি দদাসি যৎ তপস্যসি কৌন্তেয়, তৎকুরুষ্ব মদর্ঘণম্।”
অর্থাৎ, তুমি যা কিছু করো, তা আমার প্রতি নিবেদন করো।

যখন আপনি প্রতিদিন ভগবানকে স্মরণ করবেন এবং তাঁর প্রতি নিজেকে সঁপে দেবেন, তখন আপনার মনে সমস্ত নীচ প্রবৃত্তি, যেমন লোভ, ক্রোধ ও মোহ দূর হবে।

উপনিষদের অনুসরণ: একাগ্রতা এবং ধ্যান

লোভ থেকে মুক্তি পেতে ধ্যান একটি অপরিহার্য উপায়। ধ্যানের মাধ্যমে মন শান্ত হয় এবং জাগতিক কামনা বাসনাগুলো দূর হতে শুরু করে। “চণ্ডোগ্য উপনিষদ”-এ ধ্যানকে জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

উপনিষদে উদাহরণ রয়েছে রাজা জনকের ধৈর্য ও ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনের। তিনি বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন, কিন্তু তাঁর ভোগবিলাসে কোনো আসক্তি ছিল না। ধ্যানের মাধ্যমে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, রাজ্য বা সম্পত্তি ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আত্মা চিরন্তন।

লোভ থেকে মুক্তির চূড়ান্ত শিক্ষা: আত্মজ্ঞান ও ত্যাগের পথ

উপনিষদে বারবার ত্যাগকে সর্বোচ্চ গুণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। “তৎ ত্যক্ত্বা”—যা কিছু আপনাকে বেঁধে রাখে, তা ত্যাগ করো।
লোভমুক্ত জীবনের মূলমন্ত্র হল আত্মজ্ঞান। নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, আমাদের সত্যিকার সম্পদ বাইরের কোনো বস্তুতে নয়, আমাদের অন্তরের স্থিতিতে লুকিয়ে আছে।

চিরন্তন সত্যের পথে চলুন

লোভ থেকে মুক্তি পেতে উপনিষদের এই শিক্ষাগুলোই আমাদের জীবনের দিশা দেখায়। এই পথ কঠিন হতে পারে, কিন্তু এটি চিরন্তন আনন্দের পথে নিয়ে যায়। আসুন, আমরা সবাই মিলে ঈশ্বরচিন্তা, ত্যাগ ও জ্ঞানের আলোয় নিজেদের আলোকিত করি। কারণ এই শিক্ষাই আমাদের সনাতন ধর্মের অন্তর্নিহিত চেতনা।

ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তিঃ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top