সনাতন ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ উপনিষদ আমাদের শুধু আধ্যাত্মিক পথই দেখায় না, এটি মানবজীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করার জন্য মূল্যবান নির্দেশনা প্রদান করে। যুদ্ধ এবং সংঘাত—চাই সেটা ব্যক্তিগত জীবনে হোক বা বৃহৎ সমাজে—এগুলোর সমাধানে উপনিষদ এমন এক গভীর দর্শনের কথা বলে যা আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
সংঘাত কেন? এর শিকড় কোথায়?
উপনিষদ বলে যে, সংঘাতের মূল কারণ হলো “অবিদ্যা” বা অজ্ঞতা। আমরা যখন প্রকৃত সত্যকে ভুলে আত্মকেন্দ্রিকতায় ডুবে যাই, তখন সংঘাত সৃষ্টি হয়। মুণ্ডক উপনিষদ (১.২.১২) বলে:
“অবিদ্যায়ামন্তর্ বর্তমানাঃ, তারা পরম সত্যকে বুঝতে পারে না।”
অবিদ্যার কারণে আমরা নিজেদের আলাদা ভাবি এবং এই বিভাজনই যুদ্ধের মূল কারণ।
সমাধানের পথে: আত্মজ্ঞান এবং একাত্মতার বোধ
উপনিষদ শিক্ষা দেয় আত্মজ্ঞান লাভ করার মাধ্যমে সংঘাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ছান্দোগ্য উপনিষদে (৬.৮.৭) “তত্ত্বমসি” বা “তুই-ই সেই” বাক্যটি স্পষ্ট করে যে, সকল জীবের মধ্যে একটাই পরমাত্মা বিদ্যমান।
যখন আমরা বুঝতে পারি যে আমি, আপনি, এবং আমাদের শত্রুও একই পরমাত্মার অংশ, তখন বিরোধ মিটে যায়।
উপনিষদের পরামর্শ যুদ্ধক্ষেত্রে
যুদ্ধক্ষেত্রে সংঘাত নিরসনের জন্যও উপনিষদের শিক্ষা কার্যকর। মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের উদাহরণই ধরা যাক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে গীতায় যে জ্ঞান দেন, তার মূল ভিত্তি হলো উপনিষদ। শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
“সমত্বং যোগ উচ্যতে”
অর্থাৎ, সকল জীবের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখাই প্রকৃত যোগ।
যখন একজন যোদ্ধা এই সমত্ববোধ নিয়ে যুদ্ধ করে, তখন তিনি ব্যক্তিগত লাভ বা ক্ষতির কথা ভাবেন না। এই শিক্ষা শুধু যোদ্ধার জন্য নয়; ব্যক্তিগত জীবনের যে কোনো সমস্যার সমাধানেও এটি কার্যকর।
উপনিষদের গল্পে সংঘাত নিরসনের উদাহরণ
উপনিষদে একবার গার্গি এবং যাজ্ঞবল্ক্যের মধ্যে এক মনোমালিন্যের গল্প পাওয়া যায়। এই তর্কের মূলে ছিল আত্মার প্রকৃতি নিয়ে মতবিরোধ। কিন্তু তারা যখন সত্যের সন্ধান করতে একে অপরকে সাহায্য করলেন, তখনই তাদের সংঘাত মিটে গেল। এখানে শিক্ষাটি হলো, সত্যের সন্ধান সংঘাতের মূল সমাধান।
সংঘাত সমাধানে করণীয়
উপনিষদ অনুসারে, সংঘাত সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত কিছু পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে:
- ধ্যান এবং অন্তর্মুখিতা: নিজেকে জানার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শান্তি খুঁজুন।
- আত্মজ্ঞান অর্জন: নিজের এবং অন্যের প্রকৃত স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করুন।
- সহনশীলতা: অন্যের মতামতকে সম্মান করুন।
- ভাগবত চেতনা: প্রত্যেকের মধ্যে ভগবানের উপস্থিতি উপলব্ধি করুন।
- সাম্যবোধ: পার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে একতার চেতনা লালন করুন।
পরিশেষে: সনাতন ধর্মের শাশ্বত বার্তা
সনাতন ধর্মের মূল কথা হলো একাত্মতা। আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবনের প্রতিটি সমস্যার সমাধান আত্মজ্ঞান ও ভগবদ্ভক্তির মধ্যেই নিহিত। তাই উপনিষদের পরামর্শ অনুসরণ করে আমরা নিজেদের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি এবং পৃথিবীকেও সংঘাতমুক্ত করতে পারি।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ