আমি যখন প্রথমবার উপনিষদ’এর শ্লোকগুলোর সঙ্গে পরিচিত হলাম, তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগল – মৃত্যুর পর সত্যিই কী হয়? এটা কি শেষ, নাকি আরেকটা নতুন শুরু? আজ আমি আপনাকে উপনিষদ’এর আলোকে মৃত্যুর পর জীবনের ধারণা নিয়ে কিছু ভাবনার কথা বলব। এই আলোচনা আপনাকে জীবনকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।
উপনিষদ কী বলে মৃত্যুর পর জীবন সম্পর্কে?
উপনিষদ, যা ভারতীয় দর্শনের গভীরতম স্তরগুলোর এক অনন্য সংকলন, মৃত্যুর পরে জীবনের ধারণা নিয়ে অনেক কিছু বলেছে। এটি আমাদের আত্মার অমরত্ব ও পুনর্জন্মের ধারণাকে স্পষ্ট করে। কঠ উপনিষদে আমরা পাই, “ন যায়তে মৃতে বা কদাচিন্, নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ” (অঞ্গে নাশতের, ২.১৮) – যা বলে, আত্মা কখনো জন্মায় না এবং কখনো মরে না। এটি চিরন্তন, অবিনশ্বর।
এই শ্লোক পড়ার পর আমি বুঝতে পারি, জীবন মানে শুধু শারীরিক অস্তিত্ব নয়। এটি আত্মার এক অসীম যাত্রা।
আপনি কীভাবে এটি আপনার জীবনে প্রয়োগ করবেন?
আপনি যদি মনে করেন জীবনের মানে শুধুই জন্ম এবং মৃত্যু, তাহলে হয়তো অনেক কিছু মিস করবেন। জীবনের প্রতি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি আনতে হলে উপনিষদ’এর মতো শাস্ত্রের সাহায্য নিন। এখানে আমি আপনাকে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি, যা আপনাকে জীবনকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে সাহায্য করবে।
মোমবাতির আলো
মোমবাতি যখন জ্বলে, তার আলো আমাদের ঘরকে উজ্জ্বল করে তোলে। যখন মোমবাতি নিভে যায়, আমরা কি বলি যে আলোটি মরে গেছে? না, আলো শুধু অন্যত্র মিশে গেছে। ঠিক তেমনই, আপনার আত্মা মৃত্যুতে নিভে যায় না; এটি কেবল অন্য এক রূপে চলে যায়।
নদীর জল
আপনি কি কখনো ভেবেছেন নদীর জল সমুদ্রে মিশে গেলে তার কী হয়? নদী তার অস্তিত্ব হারায় না; বরং সমুদ্রের বিশালতায় অন্তর্ভুক্ত হয়। উপনিষদ বলে, “অহম্ ব্রহ্মাস্মি” – আমি ব্রহ্ম। মৃত্যুর পর আপনার আত্মা এই মহাবিশ্বের বৃহত্তর সত্যে মিশে যায়।
কৃষ্ণগহ্বর
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, কৃষ্ণগহ্বর কেবল বস্তু নয়, বরং এক নতুন সম্ভাবনার দরজা। উপনিষদও তাই বলে – মৃত্যু এক শেষ নয়, বরং নতুন জীবনের দরজা। “যদা পশ্যতি কশ্চিদ্ধীরঃ, সমং সর্বেষু ভূতেষু” (ইশাপনিষদ, ৬.২৯) – যা বলে, আত্মার এই অন্তর্গত সমতা বোঝার মধ্যেই জীবনের প্রকৃত অর্থ।
আপনার জীবনে আত্মার অমরত্বের ধারণা কীভাবে কাজে লাগবে?
- ভয়মুক্ত জীবন যাপন করুন মৃত্যুর ভয় আমাদের জীবনে এক প্রধান প্রতিবন্ধক। যদি আপনি বুঝতে পারেন যে আত্মা অমর, তাহলে এই ভয় আপনাকে আর আটকে রাখবে না।
- অহংকার ছাড়ুন উপনিষদ বলে, আমাদের অহংকারই আমাদের সত্যিকে ঢেকে রাখে। যখন আপনি বুঝবেন, জীবন এবং মৃত্যু একই চক্রের অংশ, তখন আপনি নিজের অহংকার ছেড়ে আরও বিনম্র হয়ে উঠবেন।
- সম্পর্কের গভীরতা অনুভব করুন আপনি কি কখনো অনুভব করেছেন, আপনার প্রিয়জনের মৃত্যুর পরেও তাদের স্মৃতি আপনার সঙ্গে রয়ে গেছে? উপনিষদ এই অনুভূতিকে বলে আত্মার সম্পর্ক। এই বোঝাপড়া আপনাকে আরও গভীর এবং সমৃদ্ধ সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করবে।
উদাহরণ ৪: গাছের পাতা
গাছের পাতা ঝরে পড়ে, কিন্তু গাছ তার শিকড়ে রয়ে যায়। এটি একটি নতুন পাতা তৈরি করার জন্য প্রস্তুত থাকে। আপনি এবং আমি একই চক্রের অংশ।
উপনিষদ থেকে আরও কিছু অনুপ্রেরণা
- “তত্ত্বমসি” (ছাংদোগ্যপ, ৬.৮): আপনি সেই চিরন্তন সত্য। এটি আপনাকে আপনার জীবনের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।
- “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছাংদোগ্যপ, ৩.১৪): এই মহাবিশ্বের সব কিছুই ব্রহ্ম। আপনি যদি এই ধারণা বুঝতে পারেন, তাহলে আপনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পবিত্র হয়ে উঠবে।
- “নায়ম্ আত্মা বলহীনেন লভ্যঃ” (কঠোপনিষদ, ১.২.২৩): আত্মাকে উপলব্ধি করতে হলে আপনাকে নিজের শক্তি ও দৃঢ়তায় ভরসা রাখতে হবে।
উপসংহার
মৃত্যুর পর জীবন নিয়ে ভাবনার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনি আপনার বর্তমান জীবনকে কীভাবে ব্যবহার করছেন। উপনিষদ আমাদের শেখায় যে জীবন হলো এক মহাযাত্রা, যেখানে মৃত্যু কেবল একটি বিরতি। আপনি যদি আপনার জীবনকে গভীরতা এবং উপলব্ধির সঙ্গে পরিচালনা করেন, তাহলে মৃত্যুর ভয় আপনাকে আর দমন করতে পারবে না।