আমি সবসময়ই মনে করি, উপনিষদ আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দেয়। এই প্রাচীন জ্ঞানসম্ভার আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো কেমন হওয়া উচিত, তার উপরও আলোকপাত করে। ভাই-বোনের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, তা বোঝার জন্য যদি আমরা উপনিষদের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে এটি কেবলমাত্র পারিবারিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক বন্ধনের প্রতীক।
ভাই-বোনের সম্পর্ক: উপনিষদের দৃষ্টিভঙ্গি
উপনিষদে সম্পর্ককে সবসময় সম্মানের সাথে বর্ণনা করা হয়েছে। “মা তে ভবতু মা বিজারথঃ” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৮.৭.১) এই শ্লোকটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা যেন একে অপরের প্রতি দয়া এবং ভালোবাসা প্রদর্শন করি। ভাই-বোনের সম্পর্ক এমন এক বন্ধন, যেখানে শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা এবং নিঃস্বার্থতা প্রাধান্য পায়।
আপনার কি মনে হয়, ভাই-বোনের মধ্যে কখনো দ্বন্দ্ব হওয়া উচিত? আমরা জানি, ছোটখাটো মনোমালিন্য সম্পর্কেরই অংশ। কিন্তু উপনিষদ আমাদের শেখায়, এইসব ছোট দ্বন্দ্বগুলো যেন কখনোই বড় হয়ে আমাদের সম্পর্কের মূলে আঘাত না হানে। “সহনা ভবতু সহনৌ ভুনক্তু” (ঋগ্বেদ ১০.১৯১.৪) – এই প্রার্থনাটি আমাদের বোঝায়, একসাথে থাকা এবং একে অপরকে সাহায্য করা সম্পর্কের মূলমন্ত্র।
ভাই-বোনের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য উপনিষদের শিক্ষা
উপনিষদে বিভিন্ন উদাহরণ ও দর্শন রয়েছে যা আমাদের শিক্ষা দেয়, ভাই-বোনের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত। এখানে আমি তিনটি প্রধান উপদেশের কথা বলব।
১. দায়িত্ব এবং সমর্থন
একটি সুস্থ সম্পর্কের জন্য দায়িত্ববোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাই হিসেবে, আমি যদি আমার বোনের প্রতি দায়িত্ব পালন করি, তাহলে সেই সম্পর্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে শক্তিশালী হবে। “অতিথি দেবো ভব” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ ১.১১.২) – এই শ্লোকটি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি বুঝেছি, আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে সম্মান জানানো উচিত। আমার বোন যদি কোনো সমস্যায় পড়ে, তবে আমি তার পাশে দাঁড়াব। একইভাবে, বোনও ভাইয়ের জীবনে সমর্থন জোগাতে পারে।
২. অহিংসা এবং সহানুভূতি
“অহিংসা পরম ধর্ম” (মহাভারত, শান্তি পর্ব) – এই কথাটি শুধু বাইরের জগতের জন্য নয়, ঘরের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আপনি যদি আপনার ভাই বা বোনের প্রতি সহানুভূতি এবং অহিংস মনোভাব বজায় রাখেন, তাহলে সম্পর্কটি দীর্ঘস্থায়ী হয়। উদাহরণস্বরূপ, ছোটবেলার খুনসুটি যদি সীমা অতিক্রম করে, তাহলে তা আঘাতে পরিণত হতে পারে। তাই, সবসময় শান্ত থাকা এবং ভালোবাসা প্রদর্শন করা জরুরি।
৩. একসাথে শিখতে এবং বেড়ে উঠতে শেখা
উপনিষদে শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। “সত্যমেব জয়তে” (মুন্ডক উপনিষদ ৩.১.৬) আমাদের শিখায়, সত্যের পথে থাকা। ভাই-বোন একসাথে শিখতে পারে, একে অপরের ভুল সংশোধন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আমি যখন পড়াশোনার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যায় পড়ি, তখন আমার বোন আমাকে সাহায্য করে। আবার, আমি তাকে জীবনের কোনো শিক্ষা দিতে পারি। এই পারস্পরিক শিক্ষা আমাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে।
উপনিষদের শিক্ষা আমাদের জীবনে কীভাবে প্রয়োগ করা যায়
আমাদের পারিবারিক জীবনে উপনিষদের শিক্ষাগুলো প্রয়োগ করা আসলে খুব সহজ। আমি এখানে তিনটি বাস্তব উদাহরণ দেব:
- পারস্পরিক সহযোগিতা: ছোটবেলায়, আমি এবং আমার বোন একসাথে খেলতাম। কোনো সমস্যা হলে আমরা একে অপরকে সাহায্য করতাম। এটি আমাদের সম্পর্কে সহানুভূতির ভিত্তি গড়ে তুলেছে।
- সত্যবাদিতা: আমি একবার পরীক্ষার ফলাফল লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম, কারণ আমি ভালো নম্বর পাইনি। তখন আমার বোন আমাকে বলেছিল, “সত্যমেব জয়তে।” সেই দিন থেকে আমি সত্যের পথে থাকার চেষ্টা করি।
- সম্মান প্রদর্শন: উপনিষদের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমি আমার বোনের মতামতকে সবসময় গুরুত্ব দিই। সে যখন কোনো মতামত দেয়, আমি তা মন দিয়ে শুনি।
উপনিষদের উক্তি ও আমাদের দৈনন্দিন জীবন
উপনিষদের কিছু বিশেষ উক্তি ভাই-বোনের সম্পর্ককে আরও গভীর এবং অর্থবহ করে তুলতে পারে।
- “মিত্রায় ন সু চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষামহে” (ঋগ্বেদ ৫.৬৪.১): সবাইকে বন্ধুর চোখে দেখো। ভাই-বোনের সম্পর্কেও এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রযোজ্য।
- “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১): সবকিছু ব্রহ্মের অংশ, তাই আমাদের একে অপরকে সেই পবিত্রতার সাথে দেখতে হবে।
- “মা গৃহে চিদ্বেষমূদ্বোসতী” (ঋগ্বেদ ১০.১৯১.৩): ঘরে কখনো বিদ্বেষ রাখো না। এই উক্তি আমাদের শেখায়, ভাই-বোনের মধ্যে কোনো রকম ঘৃণা বা রাগ যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয়।
উপসংহার
উপনিষদ আমাদের শিখায় যে ভাই-বোনের সম্পর্কের মূল হল ভালোবাসা, সম্মান, এবং দায়িত্ব। এই সম্পর্ক আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটিকে যত্নসহকারে লালন করতে হবে। আমি মনে করি, যদি আমরা উপনিষদের শিক্ষা মেনে চলি, তাহলে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কগুলো শুধু মজবুতই হবে না, বরং তা আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের অংশ হয়ে উঠবে।
তাহলে, আপনি কি উপনিষদের এই শিক্ষাগুলোকে আপনার ভাই-বোনের সাথে সম্পর্ক আরও মজবুত করার জন্য প্রয়োগ করবেন? উপনিষদ আমাদের শিখায়, জীবন কেবলমাত্র জীবনযাপনের জন্য নয়, বরং তা সত্যিকারের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য।