সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি হলো সাম্য, শান্তি ও মানবতার প্রচার। আর এর অন্যতম প্রধান গ্রন্থ উপনিষদ। এই গ্রন্থগুলিতে কেবল আত্মার মুক্তির পথই দেখানো হয়নি, মানব সমাজে সাম্য ও বৈষম্যহীন জীবন গড়ার দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। আজ আমরা উপনিষদের আলোকে বৈষম্য দূর করার উপায়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করব।
সমস্ত প্রাণীর সমানত্ব: “তৎত্বমসি”
উপনিষদে একটি বিখ্যাত মন্ত্র আছে, “তৎত্বমসি” (তুমি-ই সেটি)। এই মন্ত্রের অর্থ হলো, সব জীব, মানুষ, এবং সৃষ্টির মূল একই—ব্রহ্ম। এটি স্পষ্ট করে যে, জাত-পাত, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ থাকা উচিত নয়। আপনি যে গৃহস্থ, আমি যে ব্রাহ্মণ, এবং অন্যজন যে শ্রমিক, আমরা প্রত্যেকেই এক। এই শিক্ষাটি বৈষম্যের মূল শিকড়ে আঘাত করে এবং সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে শেখায়।
“বসুধৈব কুটুম্বকম”: একটি বিশ্বজনীন পরিবার
“বসুধৈব কুটুম্বকম”, অর্থাৎ “পৃথিবী একটি পরিবার”, এই উপনিষদীয় ধারণাটি অসাধারণভাবে বৈষম্য দূর করার পথ দেখায়। আপনি, আমি, এবং পুরো পৃথিবী এক পরিবারের মতো। যখন আমরা এই দর্শন মেনে চলি, তখন জাতি, ধর্ম বা পেশা নিয়ে কোনো বৈষম্য থাকতে পারে না। এই ভাবনাটি সমাজের মধ্যে থাকা বিভেদের চিহ্নগুলো মুছে দেয়।
অদ্বৈতবাদ: একতার মূলমন্ত্র
উপনিষদ অদ্বৈতবাদের (অদ্বিতীয় বা একাত্মতা) উপর জোর দেয়। “ব্রহ্ম সত্যং, জগৎ মিথ্যা”—এই শ্লোকের মাধ্যমে উপনিষদ বলে, যে পার্থিব ভেদাভেদ মিথ্যা। একমাত্র ব্রহ্ম সত্য, যা প্রত্যেকের মধ্যেই বিরাজমান। যখন কেউ উপলব্ধি করে যে, আমরা প্রত্যেকে এক, তখন বৈষম্য আর থাকে না।
“শরণাগতিঃ”: সবার জন্য মুক্তির পথ
উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে, মুক্তির পথ সবার জন্য খোলা। ধনী বা গরিব, পণ্ডিত বা অজ্ঞ, সবার একমাত্র লক্ষ্য হলো পরমাত্মার সাথে মিলন। উদাহরণস্বরূপ, আমরা বেদব্যাসকে দেখতে পাই। তিনি জাতিতে মৎস্যকন্যার পুত্র হলেও জ্ঞান ও যোগ্যতায় ঋষি হয়েছেন। সনাতন ধর্মের এই উদাহরণটি আমাদের শেখায় যে, জ্ঞান ও পবিত্রতাই মূল, জাত বা অবস্থান নয়।
গুরু-শিষ্য সম্পর্কের সাম্য
উপনিষদে গুরু-শিষ্য সম্পর্কের দৃষ্টান্তে সাম্যের মন্ত্র স্পষ্ট। যেমন, ঋষি শাণ্ডিল্যের শিষ্য ছিলেন বহু জাতির মানুষ। তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। জ্ঞান আহরণের জন্য যোগ্যতাই মূল, জাত বা লিঙ্গ নয়।
সনাতন ধর্মে নারী-পুরুষের সমান অধিকার
উপনিষদে নারী-পুরুষের ভেদাভেদের স্থান নেই। গার্গী ও মৈত্রেয়ীর মতো নারী ঋষিরা এর উদাহরণ। তারা জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং জ্ঞান বিতরণ করেছেন। এটি দেখায় যে, নারী এবং পুরুষ উভয়েই সমানভাবে আত্মা ও ব্রহ্মের পথে অগ্রসর হতে পারেন।
আমাদের শিক্ষণীয়
উপনিষদ শুধু আধ্যাত্মিকতার কথা বলে না, এটি আমাদের জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ তৈরির দিশা দেয়। বৈষম্য দূর করার জন্য উপনিষদ আমাদের যা শেখায় তা এক কথায় অসাধারণ:
- সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখা।
- জাত, ধর্ম বা অবস্থানের ঊর্ধ্বে ওঠা।
- জ্ঞান এবং আত্ম উপলব্ধিকে জীবনের লক্ষ্য করা।
সনাতন ধর্মের মূল বক্তব্য হলো সকলের জন্য কল্যাণ, যা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের ভিত্তি। আসুন, আমরা প্রত্যেকে এই শিক্ষাগুলো গ্রহণ করি এবং আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর ও সাম্যপূর্ণ করে তুলি।
অন্তিম ধ্যান:
“একই চেতনার আলোতে জ্বলে উঠুক সকলের জীবন। ব্রহ্মাণ্ডের একতার মধ্যেই বৈষম্য দূর করার সত্য লুকিয়ে।”