আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, বিলাসিতার পিছনে ছুটে আমরা কতটা ক্লান্ত হয়ে পড়ছি? প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানগ্রন্থ উপনিষদ আমাদের শেখায়, সুখ ও প্রশান্তি কখনও বাহ্যিক জিনিসে থাকে না। সত্যিকারের সুখ আত্মার গভীরে, যা আমরা বিলাসিতার মোহ ত্যাগ করলেই খুঁজে পাই। আজ, আমি আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করব কীভাবে বিলাসিতা থেকে দূরে থেকে একটি অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করা যায় এবং কেন উপনিষদে এ বিষয়ে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাহ্যিক মোহ
উপনিষদ বলে, “তৈন ত্যক্তৈন ভুঞ্জীথাঃ” অর্থাৎ, “ত্যাগ কর এবং ভোগ কর।”
প্রথমে শুনতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু এর গভীর অর্থ হল, যা আমাদের প্রকৃত সুখ দেয় না, তা ত্যাগ করাই সঠিক পথ। বিলাসিতা হল সেই বাহ্যিক মোহ, যা আমাদের জীবনকে জটিল করে তোলে। আমরা সবসময় আরও ভালো বাড়ি, গাড়ি, গয়না বা স্মার্টফোনের পেছনে দৌড়াই। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন, এই বস্তুগুলি কি সত্যিই আপনাকে শান্তি দেয়?
আমার নিজের জীবন থেকে একটি উদাহরণ দিই। একসময় আমিও ভেবেছিলাম, একটি দামী ঘড়ি কিনলে আমি আরও আত্মবিশ্বাসী বোধ করব। ঘড়ি কিনলাম, কিন্তু কয়েকদিন পর সেই আনন্দ ফিকে হয়ে গেল। তখন বুঝলাম, সেই ঘড়ি শুধু আমার বাহ্যিক চাহিদা পূরণ করেছিল, কিন্তু অভ্যন্তরীণ শান্তি দেয়নি।
উপনিষদে বলা হয়েছে, “ন কঞ্চন মৃগয়া সুখম্” অর্থাৎ, “বাহ্যিক জিনিসে সুখ নেই।”
এই উপলব্ধি আমাকে বিলাসিতা থেকে দূরে থাকতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
প্রকৃত সুখের সন্ধানে
আপনার জীবনেও নিশ্চয়ই এমন ঘটনা ঘটেছে, যেখানে আপনি কিছু বিলাসবহুল পণ্য পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই পণ্য পাওয়ার পর বুঝলেন, সুখটা ঠিক স্থায়ী নয়।
এখানে উপনিষদের একটি উক্তি মনে আসে: “সন্তোষম্ পরম সুখম্” অর্থাৎ, সন্তুষ্টিই হল পরম সুখ। প্রকৃত সুখ আসে তখনই, যখন আপনি যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, একদিন আপনি পাহাড়ি গ্রামে ঘুরতে গেলেন। সেখানকার মানুষ হয়তো খুব সাধারণ জীবনযাপন করে, কিন্তু তাদের মুখে যে প্রশান্তির হাসি, তা কি আপনি শহরের বিলাসবহুল জীবনে দেখতে পান? এটি প্রমাণ করে, সুখ বাহ্যিক বস্তুতে নয়, বরং অভ্যন্তরীণ শান্তিতে।
বিলাসিতা ত্যাগের উপায়
আপনি কি ভাবছেন, বিলাসিতা ত্যাগ করবেন কীভাবে? আমি আপনাকে কয়েকটি সহজ পরামর্শ দিতে পারি।
১. প্রয়োজন বনাম ইচ্ছা চিন্হিত করুন: প্রথমে বোঝার চেষ্টা করুন কোনটা আপনার প্রয়োজন এবং কোনটা শুধুমাত্র ইচ্ছা। উদাহরণস্বরূপ, স্মার্টফোন আপনার প্রয়োজন, কিন্তু প্রতি বছর নতুন মডেল কেনা বিলাসিতা। উপনিষদে বলা হয়েছে, “যঃ তুচ্ছে স্থিতিমান্ স ঋষিঃ” অর্থাৎ, “যে অপ্রয়োজনীয় বস্তু ত্যাগ করে, সেই প্রকৃত ঋষি।”
২. সাধারণ জীবনযাপন করুন: সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত শান্তি। বাড়িতে খুব বেশি আসবাব বা অলংকার কেনার বদলে পরিবেশবান্ধব জিনিস কিনুন।
৩. আত্মানুসন্ধান করুন: উপনিষদে বলা হয়েছে, “আত্মা বৈ অদিত্যম্” অর্থাৎ, আত্মার মধ্যেই সবকিছু রয়েছে। প্রতিদিন কিছু সময় যোগ বা ধ্যানের জন্য রাখুন। এটি আপনাকে আপনার প্রকৃত চাহিদা বুঝতে সাহায্য করবে।
৪. দান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন: যা আপনার প্রয়োজনের বাইরে, তা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিন। আপনি যদি একটি পুরানো জামা দান করেন, তবে সেটা একজনের জন্য অমূল্য হতে পারে। এই অভ্যাস আপনাকে বিলাসিতার প্রতি মোহ কমাতে সাহায্য করবে। উপনিষদে বলা হয়েছে, “দম্যত, দত্ত, দয়ধ্বম্” অর্থাৎ, সংযম রাখো, দান করো, এবং দয়া প্রদর্শন করো।
বিলাসিতার পরিণতি
বিলাসিতার একটি বড় সমস্যা হল, এটি কখনও তৃপ্তি দেয় না। আপনি একবার বিলাসিতার মোহে পড়লে, এর শেষ নেই। উপনিষদে বলা হয়েছে, “অসন্তোষঃ সর্বনাশায়।” অতিরিক্ত লোভ ও অসন্তোষ আমাদের জীবনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।
আজকের সমাজে আমরা এটি চারপাশে হরহামেশা দেখি। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি যখন নতুন মডেলের গাড়ি কেনে, সে তা অন্যকে দেখানোর জন্য। কিছুদিন পর, আরেকজন আরও ভালো গাড়ি কিনলে তার নিজের গাড়ির প্রতি আকর্ষণ কমে যায়। এই প্রতিযোগিতা কখনো শেষ হয় না। উপনিষদ আমাদের শেখায়, এই অসীম চক্র থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হল বিলাসিতার মোহ ত্যাগ।
উপসংহার
উপনিষদের জ্ঞান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, “সর্বং দুখম্ অযশস্মিতাম্।” অর্থাৎ, যেখানে অহংকার ও বিলাসিতা আছে, সেখানে দুঃখ অবশ্যম্ভাবী।
আমি আপনাকে প্রশ্ন করে বিদায় নিতে চাই: আপনার জীবনে কি এমন কিছু বিলাসিতা রয়েছে যা আপনি ছেড়ে দিতে পারেন? যদি আজ আপনি একটি বিলাসী চাহিদা ত্যাগ করেন, তবে আপনি কি আরও বেশি শান্তি অনুভব করবেন না?
যতই আমরা বিলাসিতা ত্যাগ করব, ততই আমরা প্রকৃত সুখের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারব। আসুন, উপনিষদের পথ অনুসরণ করে আমাদের জীবনকে সহজ এবং অর্থবহ করে তুলি।