আপনি কি কখনও ভেবেছেন, আমরা সবাই কিভাবে ভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস নিয়ে একসঙ্গে বাস করি? এই পৃথিবীর বৈচিত্র্যময়তাই আমাদের জীবনের সৌন্দর্য। তবে এই বৈচিত্র্যের মধ্যে যদি আমরা সহনশীল না হই, তবে তা কেমন হবে? আমি বিশ্বাস করি, বিভিন্ন ধর্মের প্রতি সহনশীল হওয়া শুধুমাত্র একটি নৈতিক গুণ নয়, বরং এটি আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপনিষদের দৃষ্টিভঙ্গি
উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে, জীবন ও বিশ্বজগৎ এক অখণ্ড সত্তা। এই সত্তার অংশ আমরা প্রত্যেকেই। “একং সৎ, বিপ্রা বহুধা বদন্তি” — অর্থাৎ সত্য একটাই, কিন্তু জ্ঞানীরা একে বিভিন্ন নামে ডাকে। এখানে স্পষ্ট যে, বিভিন্ন ধর্ম এবং মতবাদ সত্যের বিভিন্ন দিক প্রকাশ করে। একে স্বীকার করাই হল সহনশীলতার মূল। আপনি যদি অন্যের ধর্ম বা বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে শিখেন, তবে আপনি এই একতার উপলব্ধি করতে পারবেন।
সহনশীলতার উদাহরণ
একবার আমি এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম, যিনি ইসলাম ধর্মের অনুসারী। সেখানে ইফতারের আয়োজন ছিল। আমি হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও তাদের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। সেই অভিজ্ঞতা আমার জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় ছিল। এর বিপরীতে, আমার সেই বন্ধু দুর্গাপূজার সময় আমাদের বাড়িতে এসে প্রসাদ গ্রহণ করেছিল। এই ধরনের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, ধর্ম কেবলমাত্র বিশ্বাসের নয়, এটি মানবতার প্রতি শ্রদ্ধারও প্রতীক।
আরেকটি উদাহরণ হল মহাত্মা গান্ধীর জীবন। তিনি গীতা, বাইবেল এবং কোরানের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর মতে, “আমি সব ধর্মের সমান সত্যতা ও ভুল ত্রুটি দেখি। তবে আমি প্রতিটি ধর্মের মর্মার্থে ঈশ্বরের দর্শন করি।” গান্ধীর জীবন আমাদের শেখায়, সহনশীলতার মাধ্যমে কিভাবে একটি সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
সহনশীলতার অভাবের ফলাফল
যখন সহনশীলতার অভাব দেখা দেয়, তখন সমাজে হিংসা এবং বিভাজন তৈরি হয়। একবার এক সংবাদে দেখেছিলাম, ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে একটি ছোট্ট শহরে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছিল। সেখানে মানুষ ধর্মের নামেই অপরাধ করেছিল। এই ধরনের ঘটনাগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সহনশীলতা ছাড়া আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজের কল্পনাও করতে পারি না।
উপনিষদের আরও কিছু উপদেশ
উপনিষদে আরও বলা হয়েছে, “অত্মা সর্বভূতে গুহায় বসতি করে” — আত্মা সকল জীবের মধ্যেই বিরাজমান। যখন আপনি এই উপলব্ধি করবেন, তখন আপনি আর অন্য কাউকে বিচ্ছিন্ন মনে করবেন না। বরং, আপনি বুঝতে পারবেন যে, আপনার ধর্ম এবং অন্যের ধর্ম একই আধ্যাত্মিক সত্যের বিভিন্ন প্রকাশ।
একটি অন্য উক্তি মনে পড়ছে: “ইশাবাস্যমিদং সর্বং” — এই জগতের প্রতিটি বস্তু ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছন্ন। যখন আমরা এই ধারণাটি হৃদয়ঙ্গম করি, তখন আমরা সমস্ত জীবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখি।
আপনার জীবনে সহনশীলতা কীভাবে আনবেন?
এখন আপনি হয়তো ভাবছেন, “আমি কীভাবে সহনশীল হতে পারি?” আমি এখানে কয়েকটি সহজ পরামর্শ দিতে পারি:
- অন্যের ধর্ম সম্পর্কে জানুন: আপনি যদি বিভিন্ন ধর্মের মূল শিক্ষা জানেন, তবে আপনার মধ্যে বিভেদ দূর হবে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলাম শান্তির কথা বলে, খ্রিস্টধর্ম প্রেমের কথা বলে এবং হিন্দুধর্ম মুক্তির কথা বলে।
- আলোচনার মাধ্যমে বোঝাপড়া বাড়ান: বিভিন্ন মতবাদ নিয়ে আলোচনা করলে আপনি দেখবেন, ভিন্ন মতের মধ্যেও অনেক মিল রয়েছে।
- মানবতাকে প্রাধান্য দিন: সব ধর্মের মূলেই রয়েছে মানবতার শিক্ষা। যদি আমরা মানবতাকে সম্মান করি, তবে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন কমে যাবে।
উপসংহার
সহনশীলতা হল একটি আধ্যাত্মিক গুণ, যা আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে। এটি আমাদের আত্মা এবং সমাজকে একত্রিত করে। আপনি যদি উপনিষদের শিক্ষা অনুসরণ করেন, তবে আপনি বুঝতে পারবেন, সমস্ত ধর্ম একই সত্যের দিকে পরিচালিত করে। তাই আজ থেকেই আমরা সহনশীলতা চর্চা শুরু করতে পারি।
অবশেষে, আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই, “আপনি কি নিজের জীবনে সমস্ত ধর্মের প্রতি সেই সমান শ্রদ্ধা এবং সহনশীলতা আনতে প্রস্তুত?”