আপনি কি কখনও ভাবেছেন, “সারা পৃথিবী আমার পরিবারের মতো হতে পারে?” এই গভীর চিন্তার পেছনে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ দর্শন: “বসুধৈব কুটুম্বকম”, যার অর্থ, “এই পৃথিবী একটি পরিবার।” এটি শুধুমাত্র একটি বাক্য নয়; এটি আমাদের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
উপনিষদে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর উল্লেখ
“অয়ং বন্ধুরয়ং নীতি গননা লঘুচেতসাম্।
উদারচরিতানাং তু বসুধৈব কুটুম্বকম্।।”
এই শ্লোকটি মহোপনিষদে পাওয়া যায়, যা আমাদের শেখায় যে সারা বিশ্ব এক অখণ্ড পরিবার। যারা সংকীর্ণ চিন্তাভাবনার, তারা নিজের-পরের মধ্যে পার্থক্য করে। কিন্তু উদার মনের মানুষের কাছে সবাই সমান।
কীভাবে “বসুধৈব কুটুম্বকম” আপনার জীবনে প্রাসঙ্গিক?
আজকের ব্যস্ত জীবনে, আমরা প্রায়ই নিজেদের সমস্যায় এতটাই মগ্ন হয়ে যাই যে, পাশের মানুষের সুখ-দুঃখের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ি। এই দর্শন যদি আমরা মেনে চলি, তবে আমরা পারি এক সম্প্রীতিময় পৃথিবী গড়তে।
মানবতার প্রতি দায়িত্ব
যখন আপনি এই দর্শনটি মেনে চলবেন, তখন বুঝতে পারবেন যে প্রত্যেক মানুষ আপনার আত্মীয়। আপনি কি জানেন, উপনিষদে বারবার এই বাণী দেওয়া হয়েছে যে, “তুমি যা, আমিও তাই”? যেমন, ছান্দোগ্য উপনিষদ বলেছে:
“তত্ত্বমসি” – তুমি সেই।
এটি আমাদের শেখায় যে আমরা সকলেই একই সৃষ্টিকর্তার অংশ।
উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার আশপাশে কেউ ক্ষুধার্ত থাকে, আপনি কি তাকে খেতে দেবেন না? কারণ একজন ক্ষুধার্ত আত্মীয়কে আপনি অবহেলা করতে পারবেন না। এই মানসিকতা আপনাকে মানবতাবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করবে।
প্রকৃতির সঙ্গে সম্প্রীতি
“বসুধৈব কুটুম্বকম” কেবল মানুষকে নয়, প্রকৃতিকেও পরিবারের অংশ হিসেবে দেখে। ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে:
“ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত্।”
এর অর্থ, সৃষ্টির প্রতিটি কণা ঈশ্বরের দ্বারা আবৃত। তাই, আপনি যদি প্রকৃতিকে পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখেন, তবে পরিবেশ রক্ষার প্রতি আপনার দায়িত্ব আরও গভীর হবে।
যেমন ধরুন, গাছ লাগানো। এটি কেবল পরিবেশ রক্ষা নয়, পরিবারের প্রতি যত্ন নেওয়ার সমান।
সম্প্রীতির বার্তা বিশ্বে ছড়ানো
বিশ্বের ইতিহাসে অনেক বড় নেতা এই দর্শন অনুসরণ করেছেন। মহাত্মা গান্ধী তাঁর অহিংস আন্দোলনে “বসুধৈব কুটুম্বকম”-এর মূল বার্তা দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, “আপনার শত্রুও আপনার আত্মীয়।” তাই তিনি কখনো সহিংসতা সমর্থন করেননি।
আপনি যদি জীবনে এই দর্শন প্রয়োগ করেন, তবে অফিসের সহকর্মী বা ব্যক্তিগত জীবনে শত্রুতার পরিবর্তে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করতে পারবেন।
পারিবারিক সম্পর্ক আরও মজবুত হয়
আপনার যদি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়, তাহলে নিজেকে মনে করান, “বসুধৈব কুটুম্বকম।” এই ধারণা আপনাকে ক্ষমা করতে এবং ভালোবাসা জাগাতে সাহায্য করবে।
উপনিষদে বলা হয়েছে:
“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম।”
এটি বোঝায়, সবকিছুই ব্রহ্মময়। যখন আপনি এটি বুঝতে পারবেন, তখন ছোট ছোট ভুলগুলোকে ক্ষমা করতে শিখবেন।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ
- একটি গ্রাম যেখানে কেউ ক্ষুধার্ত থাকে না
ভারতের কিছু গ্রামে, “বসুধৈব কুটুম্বকম” বাস্তবে পালন করা হয়। এখানে যদি কেউ কোনোদিন খেতে না পায়, প্রতিবেশীরা তাকে খাবার দেয়। এই উদাহরণ আমাদের শেখায় কীভাবে মানবিক সম্পর্ককে মজবুত করা যায়। - প্রকৃতি প্রেমের উদাহরণ
পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সুইডেনের মানুষ “বসুধৈব কুটুম্বকম”-এর চর্চা করে। তারা পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিস ব্যবহার করে এবং প্রকৃতিকে রক্ষা করে। আপনি যদি এই অভ্যাসটি গ্রহণ করেন, তবে আপনি পৃথিবীকে আরও সুন্দর রাখতে পারেন। - জাতি-ধর্মের বিভেদ ভাঙা
একটি স্কুলে, বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়াশোনা করে। তাদের শেখানো হয়, “তোমরা সবাই এক পরিবারের অংশ।” এটি শিশুদের মধ্যে বিভাজন কমিয়ে আনে এবং ভালোবাসা জাগায়।
আমি ও আপনি কীভাবে এটি জীবনে প্রয়োগ করতে পারি?
আপনি ভাবছেন, “আমার একার পক্ষে কী সম্ভব?” হ্যাঁ, সম্ভব।
- প্রথমে, আপনি নিজের পরিবার থেকে শুরু করুন। পরিবারে ভালোবাসা ও সম্মান বজায় রাখুন।
- এরপর, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ুন।
- শেষমেশ, পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় হন।
আমাদের প্রত্যেকের ছোট ছোট প্রচেষ্টা একত্রিত হয়ে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
উপসংহার
“বসুধৈব কুটুম্বকম” শুধু একটি দর্শন নয়; এটি জীবনের এক অভিন্ন পথ। যখন আপনি এই ধারণা গ্রহণ করবেন, তখন আপনার জীবন এবং সমাজ আরও উন্নত হবে। উপনিষদের এই মূল্যবান বার্তা আমাদের শেখায় ভালোবাসা, সমতা এবং সম্প্রীতি।