প্রেম, এই শব্দটি আমাদের জীবনে যেমন সুখ নিয়ে আসে, তেমনই যদি এটি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে দুঃখও বয়ে আনতে পারে। বিশেষত, প্রেমের ক্ষেত্রে অহংকার ও স্বার্থপরতা সম্পর্কের ভিত নষ্ট করে দিতে পারে। আমি মনে করি, প্রেমের প্রকৃত অর্থ বুঝতে হলে আমাদের আত্মজ্ঞান এবং ত্যাগের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হবে। এটি আমরা ভালোভাবে শিখতে পারি উপনিষদের গভীর জ্ঞান থেকে। আজ আমি এবং আপনি একসঙ্গে আলোচনা করব, কীভাবে অহংকার ও স্বার্থপরতাকে এড়িয়ে প্রকৃত প্রেমে স্থিতি লাভ করা যায়।
অহংকার এবং স্বার্থপরতার প্রকৃতি
অহংকার এমন এক অনুভূতি যা আমাদের নিজেদেরকে অপরের উপরে স্থান দিতে শেখায়। স্বার্থপরতা হল সেই মানসিকতা, যেখানে আমরা শুধুমাত্র নিজের চাহিদাকে গুরুত্ব দিই। প্রেমের ক্ষেত্রে এই দুটি গুণ সম্পর্কের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। যেমন, আপনি যদি সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, বা কেবল নিজের সুখ নিয়ে ভাবেন, তবে আপনি এবং আপনার সঙ্গীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে বাধ্য।
উপনিষদ বলে, “অহংকার মানুষকে অন্ধ করে তোলে, এবং সত্যকে উপলব্ধি করা থেকে দূরে রাখে।” প্রেমে এই অহংকার যদি প্রবেশ করে, তবে তা সম্পর্ককে ভারসাম্যহীন করে দেয়।
উপনিষদের আলোকে প্রেমে অহংকার দূরীকরণ
উপনিষদে বলা হয়েছে, “সত্যমেব জয়তে নানৃতম” — সত্যই সর্বদা জয়ী হয়, অসত্য নয়। প্রেমে অহংকার ও স্বার্থপরতাকে দূর করতে হলে আমাদের প্রথমে সত্য এবং নিজের প্রকৃত স্বভাব উপলব্ধি করতে হবে। সত্যিকার প্রেমে কখনওই অহংকারের স্থান নেই। আসুন দেখি কিছু উদাহরণ:
- মনের গভীরতা বোঝা: যখন আপনার সঙ্গী কোনো বিষয়ে দুঃখ পায়, তখন তার অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনি সবসময় নিজের যুক্তিকে প্রাধান্য দেন, তবে সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হবে। উদাহরণস্বরূপ, একবার আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিল, তার সঙ্গী তাকে প্রতিটি তর্কে হারিয়ে দিতে চায়। এটা তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়েছিল। আমরা যদি উপনিষদের শ্লোক “সহনম্ এব শক্তি” অর্থাৎ সহনশীলতাই শক্তি, মেনে চলি, তবে এই সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়।
- ত্যাগের গুরুত্ব: উপনিষদে বলা হয়েছে, “ত্যাগেনাইকেন অমৃতত্বমানশুঃ” অর্থাৎ ত্যাগের মাধ্যমে আমরা অমৃত লাভ করতে পারি। প্রেমে নিজস্ব সুখের জন্য আপনার সঙ্গীর ক্ষতি করার পরিবর্তে, একে অপরের জন্য ত্যাগ করতে শিখুন। ত্যাগের এই মানসিকতা সম্পর্ককে মজবুত করে।
- সম্প্রদানের আনন্দ: উপনিষদ শিক্ষা দেয়, “যো দদাতি স সুখী ভবতি” — যে দেয়, সে-ই সুখী হয়। নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যদি আপনি সম্পর্কের জন্য কিছু করেন, তাহলে সেই সম্পর্ক আরো গভীর এবং সুখময় হবে।
অহংকার ও স্বার্থপরতা কীভাবে এড়ানো যায়
- নিজেকে প্রশ্ন করা: আপনার আচরণ কি আপনার সঙ্গীর জন্য সমস্যার কারণ হচ্ছে? আপনি যদি নিজের অনুভূতিকে সবসময় প্রাধান্য দেন, তবে সেটা ঠিক নয়। এই প্রশ্নগুলো নিজেকে করুন এবং উত্তর খুঁজুন।
- সঙ্গে সময় কাটানো: একে অপরের সঙ্গ অনুভব করুন। অহংকার ও স্বার্থপরতার কারণে আমরা অনেক সময় নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করি। তবে একসঙ্গে সময় কাটালে এই বাধাগুলো অতিক্রম করা যায়।
- ধ্যান ও আত্মজ্ঞান: উপনিষদে বলা হয়েছে, “আত্মানং বিদ্ধি” — নিজেকে জানো। প্রতিদিন ধ্যান করুন এবং নিজের ভুলগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। ধ্যান আমাদের অহংকার কমাতে সাহায্য করে এবং সম্পর্ককে গভীর করে।
- ক্ষমার অভ্যাস গড়ে তোলা: ক্ষমা হল সম্পর্ককে শক্তিশালী করার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। উপনিষদে উল্লেখ আছে, “ক্ষান্তি পরমং বীর্যং” — ক্ষমাই সর্বোচ্চ শক্তি। আপনি যদি আপনার সঙ্গীর ভুল ক্ষমা করতে পারেন, তবে সম্পর্ক আরও সুস্থ হবে।
- আত্মত্যাগের মানসিকতা গড়ে তোলা: প্রেমে কখনও কেবল নিজের কথা ভাবা উচিত নয়। নিজেকে সঙ্গীর জন্য উৎসর্গ করার মানসিকতা থাকলে সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
আমার অভিজ্ঞতা
আমার নিজের জীবনে, আমি একবার অহংকারের কারণে আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হারিয়েছি। আমি সবসময় নিজের যুক্তিকে সঠিক প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম এবং সঙ্গীর মতামতকে গুরুত্ব দিইনি। তবে উপনিষদের শিক্ষা অনুসরণ করে, আমি ধীরে ধীরে নিজের অহংকার কমিয়ে সম্পর্ক পুনর্গঠনে সক্ষম হয়েছি। এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে, প্রকৃত প্রেমে ত্যাগ, সহানুভূতি, এবং ক্ষমা অপরিহার্য।
উপসংহার
অহংকার এবং স্বার্থপরতা প্রেমের শত্রু। যদি আপনি সত্যিকারের প্রেম চান, তবে উপনিষদের শিক্ষাগুলো অনুসরণ করুন। “সহনম্ এব শক্তি,” “ত্যাগেনাইকেন অমৃতত্বমানশুঃ,” এবং “যো দদাতি স সুখী ভবতি”—এই শিক্ষাগুলো জীবনে প্রয়োগ করুন।