পোশাক ও সাজসজ্জার ক্ষেত্রে উপনিষদ কী বলে?

আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, পোশাক এবং সাজসজ্জা আমাদের জীবনে কতটা গভীর প্রভাব ফেলে?

শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যই নয়, আমাদের মনোভাব, চরিত্র এবং আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিফলনও ঘটে এগুলোর মাধ্যমে। 

উপনিষদ, যা হিন্দু দর্শনের গভীরতম জ্ঞান এবং শিক্ষা বহন করে, পোশাক এবং সাজসজ্জার ব্যাপারে আমাদের এক গভীরতর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।

আজ আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করব—কিভাবে উপনিষদ আমাদের পোশাক ও সাজসজ্জার ক্ষেত্রে পথ দেখায় এবং সেগুলো আমাদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

উপনিষদের দৃষ্টিতে পোশাকের গুরুত্ব

উপনিষদ বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বাহ্যিক বিষয়গুলোর চেয়ে অভ্যন্তরীণ আত্মার পরিচ্ছন্নতাই আসল। তেমনই, পোশাক কেবল শরীর ঢেকে রাখার একটি উপায় নয়; এটি আমাদের মানসিকতা ও নৈতিকতার প্রতিফলন। 

ঋগ্বেদের একটি অংশে বলা হয়েছে:

“যথা চিত্রং ভানু তপস্তে যথা চ অপস্তু রেতা:”
(অর্থাৎ, প্রকৃত সৌন্দর্য তখনই উদ্ভাসিত হয় যখন এটি শুদ্ধতার সঙ্গে সংযুক্ত হয়।)

আপনি যদি নিজেকে শুদ্ধ চিন্তাভাবনায় এবং নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বে সাজান, তবে আপনার পোশাকও সেই চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ হবে।

পোশাক নির্বাচনে সরলতা ও শুদ্ধতার গুরুত্ব

উপনিষদে বারবার সরলতা এবং শুদ্ধতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

“ঈশোপনিষদ” এ বলা হয়েছে:
“তে ন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ”
(অর্থাৎ, যা প্রয়োজন তাই গ্রহণ করো, বিলাসিতা ত্যাগ করো।)

এই মন্ত্র আমাদের শেখায় যে পোশাক এবং সাজসজ্জা এমন হওয়া উচিত যা আপনার প্রয়োজন মেটায় এবং আভিজাত্যের পরিবর্তে সরলতাকে তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ, একটি সাধারণ সুতির পোশাক কেবল আরামদায়কই নয়, এটি প্রকৃতির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

আপনার পোশাক নির্বাচনের সময় নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন—এই পোশাক কি আমার আত্মার সরলতা এবং আন্তরিকতাকে প্রতিফলিত করছে? যদি আপনার পোশাক অহংকার, লোভ, বা অন্যের প্রতি ঈর্ষা সৃষ্টি করে, তবে এটি উপনিষদের শিক্ষার পরিপন্থী।

রঙ এবং অনুভূতির প্রভাব

রঙের মাধ্যমেও আমাদের মনের উপর প্রভাব পড়ে, যা উপনিষদও স্বীকার করে। ত্রিগুণ তত্ত্ব অনুযায়ী—সত্ত্ব, রজস, এবং তমস এই তিনটি গুণ আমাদের চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। সত্ত্বগুণ সম্পন্ন রঙ, যেমন সাদা, হালকা নীল বা হলুদ, আমাদের মনে শান্তি এবং পবিত্রতার অনুভূতি জাগায়।

“চন্দোগ্য উপনিষদ” এ বলা হয়েছে:
“সত্যমেব বিজয়তে নানৃতম্”
(অর্থাৎ, সত্যই জয়ী হয়, মিথ্যা নয়।)

আপনার পোশাকের রঙ যদি সত্য ও পবিত্রতাকে প্রতিফলিত করে, তবে সেটি আপনার মনকে শান্ত রাখবে এবং অন্যের মনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই গাঢ়, চটকদার রঙের পরিবর্তে এমন রঙ বেছে নিন যা আপনার জীবনের সরলতা ও আধ্যাত্মিকতাকে তুলে ধরে।

অলংকার এবং বাহ্যিক সৌন্দর্য

উপনিষদ আমাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের পেছনে দৌড়াতে নিষেধ করে।

কণাদ উপনিষদে বলা হয়েছে:
“অকামতঃ প্রকৃতিঃ”
(অর্থাৎ, প্রকৃতিতে কামনা থাকলে শান্তি থাকে না।)

অলংকার পরার সময় এই শিক্ষা স্মরণে রাখুন। আপনি কি অলংকার ব্যবহার করছেন আপনার সত্যিকারের সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য, নাকি অন্যের চোখে বড় হয়ে ওঠার জন্য? এটি ভাবা খুবই জরুরি। প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি সাদাসিধে গয়না শুধু পরিবেশের জন্যই ভালো নয়, এটি আমাদের মনের সরলতাকেও প্রতিফলিত করে।

সাজসজ্জার ক্ষেত্রে অতিরিক্ততা পরিহার

উপনিষদ অতিরিক্ততাকে সর্বদা পরিহার করার পরামর্শ দেয়।

“বৃহদারণ্যক উপনিষদ”-এ বলা হয়েছে:
“যথার্থমেতৎ।”
(অর্থাৎ, যা যথাযথ তাই গ্রহণযোগ্য।)

এই শিক্ষাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সাজসজ্জার ক্ষেত্রে কখনোই এমন কিছু করা উচিত নয় যা অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি এমন মেকআপ করেন যা আপনার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আড়াল করে, তবে এটি উপনিষদের শিক্ষা বিরোধী। আমাদের সৌন্দর্যকে শুদ্ধ এবং প্রকৃত রাখার চেষ্টা করা উচিত।

জীবনধারার সঙ্গে পোশাকের সংযোগ

আপনার পোশাক কেবল আপনার শারীরিক চাহিদাই পূরণ করে না, এটি আপনার জীবনধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন। যদি আপনি আধ্যাত্মিক পথে চলতে চান, তবে আপনার পোশাকও সেই পথের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।

উপনিষদ বলে:
“অহং ব্রহ্মাস্মি”
(অর্থাৎ, আমি ব্রহ্ম।)

এই উপলব্ধি আমাদের জানায় যে আমরা প্রত্যেকে একটি বৃহত্তর সত্তার অংশ। তাই আপনার পোশাক এবং সাজসজ্জাও এমন হওয়া উচিত যা এই সত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

উপসংহার

উপনিষদ আমাদের পোশাক এবং সাজসজ্জার ক্ষেত্রে শুদ্ধতা, সরলতা, এবং সংযমের শিক্ষায় আলোকিত করে। এটি কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যের ওপর নির্ভরশীল নয় বরং আপনার অভ্যন্তরীণ জগৎকে প্রতিফলিত করার একটি মাধ্যম। আপনি কীভাবে পোশাক পরেন এবং সাজগোজ করেন, তা আপনার আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিচ্ছবি।

তাহলে, আজ থেকেই কি আপনি আপনার পোশাক এবং সাজসজ্জার দিকে নতুনভাবে নজর দেবেন? আপনি কি প্রস্তুত নিজের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের মধ্যে এক সেতুবন্ধন তৈরি করতে? উপনিষদের এই চেতনা আপনাকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top