পিতামাতার আদর্শ আচরণ সম্পর্কে কী বলা হয়েছে?

আমরা প্রত্যেকেই জীবনে এমন কিছু আদর্শের সন্ধান করি যা আমাদের পথ দেখাবে। পিতামাতার আচরণ সেই আদর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উপনিষদ আমাদের শিক্ষা দেয় যে পিতামাতা হলেন সন্তানদের জীবনের প্রথম শিক্ষক। তাদের আচরণ শুধু পারিবারিক জীবনে নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলে। এই আলোচনায় আমি এবং তুমি মিলে উপনিষদের আলোকে পিতামাতার আদর্শ আচরণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।

উপনিষদে পিতামাতার অবস্থান

“মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব।”
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ১.১১.২)

এই উক্তিটি তুমি নিশ্চয় শুনেছ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পিতামাতা দেবতার সমান সম্মানীয়। উপনিষদ বলে, সন্তানরা যেন পিতামাতার প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল থাকে এবং তাদের আদর্শ অনুসরণ করে। তবে পিতামাতারও একটি দায়িত্ব রয়েছে—সন্তানদের এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে তারা জীবনে সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও কর্তব্যপরায়ণ হয়ে ওঠে।

পিতামাতার আচরণের গুরুত্ব

পিতামাতার জীবনধারা সন্তানদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলে। উপনিষদে উল্লেখ রয়েছে:
“যথা পিতঃ তথা পুত্রঃ।”
অর্থাৎ, পিতার জীবনধারা অনুসরণ করেই পুত্রের চরিত্র গড়ে ওঠে।

যখন তুমি একজন পিতামাতা হিসেবে সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং ধর্মনিষ্ঠ হও, তখন তোমার সন্তানও সেই গুণাবলী আয়ত্ত করতে শিখবে। যেমন ধরো, তুমি প্রতিদিন গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করো—তোমার সন্তানও ধীরে ধীরে তা অনুসরণ করবে।

উদাহরণস্বরূপ কিছু পিতামাতার আদর্শ আচরণ

  •  সততার শিক্ষা:
    সন্তানদের সততা শেখাতে পিতামাতার সততার উদাহরণ সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। একবার একজন পিতা তার সন্তানকে বলেন, “তুমি অন্যের জিনিস কখনো নিজের করে নিও না।” কিন্তু পিতার নিজেই ছোটখাটো জিনিস চুরি করার অভ্যাস ছিল। সন্তান তখন প্রশ্ন করে, “তুমি যদি না মানো, তবে আমি কেন মানব?”
  •  ধর্মনিষ্ঠ জীবনযাপন:
    চণ্ডোগ্য উপনিষদে উল্লেখ আছে:
    “সত্যমেব জয়তে।”
    পিতামাতারা যদি সত্যবাদী ও ধর্মনিষ্ঠ হন, তবে সন্তানও সেই পথে হাঁটতে শিখবে।
  •  সমান আচরণ:
    উপনিষদে পিতামাতাকে সন্তানদের প্রতি সমান আচরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ধনসম্পত্তি, সুযোগ-সুবিধা কিংবা ভালোবাসা প্রদানে পক্ষপাতহীন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  •  সংসার ও ধর্মের ভারসাম্য:
    কঠোপনিষদ বলে,
    “ধর্মমেতং ন পরিত্যজ্য।”
    অর্থাৎ সংসারের দায়িত্ব পালন করতে করতেও ধর্মের পথ কখনো ছাড়া উচিত নয়। পিতামাতারা যদি এই ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেন, সন্তানরাও তা শিখবে।

উপনিষদের আলোকে আরও কিছু উপদেশ

  •  আত্মনিয়ন্ত্রণ:
    পিতামাতার আচরণে সংযম থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি তুমি নিজে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারো, তবে সন্তানদের শান্ত থাকতে শেখাবে কীভাবে? উপনিষদ বলে,
    “দমম্ শমম্ চ।”
    অর্থাৎ, সংযম এবং শান্তি রক্ষা করা উচিত।
  •  দৃষ্টান্ত স্থাপন:
    উপনিষদে বলা হয়েছে,
    “উত্তম পুরুষরা সর্বদা অনুসরণীয়।”
    যদি পিতামাতা নিজেদের জীবনকে সুন্দর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ করে তোলেন, সন্তানরাও সেই জীবনযাপন শিখবে।

জীবন বদলানোর কিছু সহজ উপায়

তুমি যদি চাও, তোমার সন্তানরা আদর্শ জীবনযাপন করুক, তবে নিচের বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দাও:

  • প্রতিদিনের রুটিনে ধর্মীয় চর্চা যুক্ত করো।
  • সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করো।
  • তাদের ছোটখাটো ভালো কাজের প্রশংসা করতে শিখো।
  • কোনো ভুল করলে মৃদুভাবে সংশোধন করো।

এক গভীর প্রশ্ন

পিতামাতার আদর্শ আচরণ শুধুমাত্র একটি পরিবার নয়, সমগ্র সমাজকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করে তুলতে পারে। তুমি কি কখনো ভেবে দেখেছ, তোমার প্রতিদিনের আচরণ কীভাবে তোমার সন্তান ও তাদের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করছে? উপনিষদের আদর্শ জীবনে প্রয়োগ করলে আমরা সবাই কি একটি উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে পারি না?

“যত ভাবো, ততই জানো। যত জানো, ততই ভালো করো।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top