পারস্পরিক ত্যাগ ও সহমর্মিতার গুরুত্ব সম্পর্কে কী বলা হয়েছে?

আপনি কখনও ভেবেছেন, আমাদের জীবন কেমন হতো যদি ত্যাগ ও সহমর্মিতার অভাব থাকত? হয়তো আপনি বলবেন, ‘সমাজ তখন কঠোর ও স্বার্থপর হয়ে উঠত।’ ঠিক সেই কারণেই আমাদের ঋষিগণ উপনিষদে ত্যাগ ও সহমর্মিতার অনুপম মহিমা তুলে ধরেছেন। এই প্রাচীন জ্ঞান ভাণ্ডার শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। আজ আমি আপনাকে এই গুণগুলোর গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করব এবং কিছু মূল্যবান শিক্ষার কথা শেয়ার করব।

উপনিষদে ত্যাগের অর্থ

“তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ” – অর্থাৎ, “ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ করো।” ইশোপনিষদের এই শ্লোকটি আমাদের শেখায়, ত্যাগ করেই প্রকৃত সুখের আস্বাদ লাভ করা যায়। প্রথমবার শোনার পর এই কথাটি কিছুটা অস্পষ্ট লাগতে পারে, তাই না? কিন্তু যদি আমরা আমাদের জীবনে খেয়াল করি, দেখা যাবে যে, আমরা যত বেশি অন্যদের জন্য কিছু করি, ততই শান্তি ও আনন্দ অনুভব করি।

উদাহরণস্বরূপ, একজন মা তাঁর সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য নিজের স্বপ্ন ত্যাগ করেন। এই ত্যাগ কি তাকে দুঃখ দেয়? না, বরং সন্তানের সাফল্যে মা আনন্দ পান। ঠিক তেমনই, উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে যে, প্রকৃত সুখ পাওয়ার জন্য ত্যাগ অপরিহার্য।

সহমর্মিতার মূলে একাত্মতার বোধ

উপনিষদ বলে, “বসুধৈব কুটুম্বকম” – অর্থাৎ, সমগ্র পৃথিবী এক পরিবার। আমরা যদি একে অপরকে পরিবারের সদস্য হিসাবে ভাবি, তখন সহমর্মিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। এই সহমর্মিতার বোধ আমাদের শুধু সম্পর্ককে দৃঢ় করে না, বরং আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতিতেও সাহায্য করে।

একটি গল্প মনে পড়ছে – একবার এক যুবক ঋষি শিষ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “গুরুজী, আধ্যাত্মিক উন্নতির সহজতম পথ কী?” গুরু উত্তরে বললেন, “সহমর্মিতা এবং পারস্পরিক সাহায্য।” তারপরে তিনি ব্যাখ্যা করলেন, যখন তুমি অন্যের যন্ত্রণাকে নিজের বলে মনে করো, তখনই তুমি আসল শিক্ষা গ্রহণ করো।

জীবনের উদাহরণ

  • প্রতিদিনের ছোট ছোট ত্যাগ: আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন, একটি সফল সম্পর্কের ভিত্তি ত্যাগ। একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীর স্বপ্নপূরণের জন্য কিছু সময়ের জন্য তাঁর পছন্দের কাজ থেকে বিরত থাকেন। আবার স্ত্রীও সংসারের মঙ্গলের জন্য তাঁর নিজের কিছু ইচ্ছাকে ত্যাগ করেন। এই ছোট ছোট ত্যাগগুলো আমাদের সম্পর্কে আনন্দ এবং শান্তি নিয়ে আসে।
  • প্রকৃতির উদাহরণ: গাছের কথা ভাবুন। তারা আমাদের অক্সিজেন দেয়, ছায়া দেয়, ফল দেয় – কিন্তু বিনিময়ে কিছু চায় না। এই নিঃস্বার্থ দানের মানসিকতা থেকেই আমরা শিখতে পারি।
  • সহমর্মিতার প্রকাশ: আপনি যখন রাস্তার কোনো ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দেন, তখন তাঁর চোখের আনন্দ কি আপনার হৃদয় স্পর্শ করে না? এই ছোট ছোট কাজগুলোই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা সবাই একে অপরের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত।

উপনিষদের আরও কিছু মূল্যবান শ্লোক

  •  “অন্নং বহু কুর্বীত” – সর্বদা এমন কাজ করো যা অন্যদের জন্য খাবারের জোগান দেয়।
  •  “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” – এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি কণা ব্রহ্মময়। এই উপলব্ধি থেকেই সহমর্মিতা আসে।
  •  “মৈত্রীং করোতি মিত্রেষু” – শত্রুর সাথেও বন্ধুত্বের মনোভাব পোষণ করো।
  •  “ধর্মেন হীনঃ পশুভিঃ সমানঃ” – ধর্ম ছাড়া মানুষ পশুর সমান। ধর্ম এখানে সহমর্মিতা ও ত্যাগকেই বোঝায়।

ত্যাগ ও সহমর্মিতার অনুশীলন কিভাবে করবেন?

এখন আপনি হয়তো ভাবছেন, এই মূল্যবান শিক্ষাগুলো বাস্তবে কীভাবে প্রয়োগ করবেন। এখানে কয়েকটি সহজ পন্থা আছে:

  • অন্যের প্রতি মনোযোগী হন: আপনার আশেপাশের মানুষদের প্রয়োজন বুঝুন এবং তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করুন।
  • নিজের চাহিদাকে সংযত করুন: সব সময় নিজের জন্য নয়, বরং পরিবারের বা সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করুন।
  • ধ্যান ও প্রার্থনার মাধ্যমে অভ্যাস করুন: ধ্যান আপনার মনকে প্রশান্ত করে এবং আপনাকে একাত্মতার অনুভূতিতে স্থিত হতে সাহায্য করে।
  • ক্ষুদ্র সেবার কাজ: আপনি স্থানীয় গরীবদের জন্য খাবার বিতরণ করতে পারেন, বা পরিবেশ রক্ষার জন্য বৃক্ষরোপণ করতে পারেন। এই ছোট কাজগুলোও মহান প্রভাব ফেলে।

উপনিষদের চিরন্তন শিক্ষা

আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, আমরা কেন পৃথিবীতে এসেছি? উপনিষদ বলে, আমাদের উদ্দেশ্য হল পরস্পরের কল্যাণ করা এবং একতার বোধকে উপলব্ধি করা। পারস্পরিক ত্যাগ ও সহমর্মিতা আমাদের এই লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে।

শেষ করার আগে আপনাকে একটি প্রশ্ন করি – আপনি আজ এমন কী কাজ করবেন, যা অন্য কারো জীবনে আনন্দ বয়ে আনতে পারে? হয়তো এই প্রশ্নই আপনাকে উপনিষদের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top