পরিবার একটি নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে প্রত্যেক সদস্য একে অপরের পাশে থাকে। কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবেছেন, এই সম্পর্কগুলোতে সমান আচরণ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? উপনিষদে এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে যে, আমরা সবাই এক আত্মার অঙ্গ। তাই পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখা এক ধরণের আধ্যাত্মিক দায়িত্ব।
উপনিষদের দৃষ্টিতে পরিবারের গুরুত্ব
বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, “আত্মন্ব বা আর্যঃ পুত্রান্ প্রজায়ৈতি” অর্থাৎ আত্মাকে উপলব্ধি করে পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে নিজের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। আপনার সন্তান, সঙ্গী বা অভিভাবককে অন্য কারো চেয়ে বেশি বা কম গুরুত্ব দিলে পরিবারের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
যখন আপনি পরিবারের কাউকে অবহেলা করেন, তখন কি কখনো অনুভব করেছেন যে সেই আচরণ আপনার মনেও এক ধরনের অশান্তি সৃষ্টি করে? উপনিষদে এই কথাটি বারবার বলা হয়েছে যে, আমাদের মন এবং কাজের সামঞ্জস্য জীবনের শান্তির মূল চাবিকাঠি।
উদাহরণ: সমান আচরণের প্রভাব
১. অভাব বা সম্পদ ভাগাভাগি:
আমার এক বন্ধুর পরিবারে দেখেছিলাম, বাবা সবসময় বড় ছেলেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন, কারণ সে পরিবারে বেশি রোজগার করত। ছোট ছেলেটি এই আচরণে মানসিকভাবে দূরে সরে যায়। পরে যখন বাবা উপলব্ধি করেন এবং দুজনকেই সমান ভালোবাসা দিতে শুরু করেন, তখন পরিবারের বন্ধন আবার দৃঢ় হয়।
উপনিষদে বলা হয়েছে, “সর্বং হি স্যাৎ সমম্”—আমাদের উচিত সর্বত্র সমান আচরণ করা, কারণ সবই এক চেতনার অংশ।
২. গৃহিণীর ভূমিকা:
আপনার কি মনে হয়, গৃহকর্ত্রী বা গৃহিণীর কাজ ছোট হয়ে যায়? ছান্দোগ্য উপনিষদে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব”—মাতা এবং পিতা উভয়ই পূজনীয়। পরিবারে যদি নারীর অবদানকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়, তবে তা আধ্যাত্মিক ভারসাম্য নষ্ট করে।
৩. সন্তানদের মধ্যে সমতা:
অনেক পরিবারে দেখা যায়, এক সন্তানের প্রতি বেশি স্নেহ প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু আপনি কি জানেন, এর ফলে অন্য সন্তানের মনে গভীর দুঃখের সৃষ্টি হয়? ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে, “ইষা বাস্যমিদং সর্বং”—এ পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু এবং প্রাণ এক সমান শক্তির অধীন। আপনি যদি এক সন্তানকে বেশি ভালোবাসেন এবং অন্যজনকে অবহেলা করেন, তাহলে এই সমতাকে অস্বীকার করছেন।
পারিবারিক সমান আচরণের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
যখন আপনি পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমান আচরণ করেন, তখন কেবল সম্পর্কই নয়, বরং নিজেদের মধ্যেও একধরনের আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটে। উপনিষদে উল্লেখ আছে, “আত্মানং বিধি, সর্বানং বিধি”—যিনি নিজের আত্মাকে জানেন, তিনি সবাইকে জানতে পারেন।
এটি বলতে চায়, যখন আপনি সমান আচরণ করেন, তখন আপনি নিজেই নিজের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরিবারের মধ্যে এই সমান দৃষ্টিভঙ্গি কেবল সম্পর্ক দৃঢ়ই করে না, এটি আমাদের হৃদয়ে প্রশান্তি আনে।
কিভাবে সমান আচরণ চর্চা করবেন?
১. আত্মসমীক্ষা করুন:
প্রতিদিনের কাজের শেষে নিজেকে প্রশ্ন করুন—আমি আজ পরিবারের সবার প্রতি সমান আচরণ করেছি কি না? যদি না করে থাকেন, তাহলে পরের দিন থেকে মনোযোগী হন।
২. উপনিষদের নির্দেশিকা গ্রহণ করুন:
উপনিষদের শিক্ষা অনুসারে, নিজের চেতনার প্রসার ঘটান। যেমন, “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”—এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণই ব্রহ্মের অংশ। তাই সবাই সমান।
৩. সংলাপ বাড়ান:
পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান এবং প্রত্যেকের মতামতকে গুরুত্ব দিন। সমান আচরণ মানে কেবল আর্থিক সমতা নয়, মানসিক সমর্থনও।
উপসংহার
উপনিষদ আমাদের শিক্ষা দেয় যে, জীবনের আসল সার্থকতা কেবল নিজের জন্য নয়, বরং সকলের জন্য জীবনযাপন করার মধ্যেই নিহিত। পরিবারের প্রতি সমান আচরণ এরই একটি অংশ।