আমরা প্রায়ই জীবনের পথে হাঁটতে গিয়ে ভাবি, আমাদের পরিবারে পুরুষ ও নারীর ভূমিকা কীভাবে সঠিকভাবে নির্ধারিত হতে পারে। উপনিষদের জ্ঞান এই প্রশ্নের একটি গভীর এবং মূল্যবান উত্তর দেয়। পরিবার কেবল সম্পর্কের বন্ধন নয়, এটি এক পবিত্র স্থান যেখানে আমরা একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ ও শ্রদ্ধা অনুভব করি। পরিবারে পুরুষ ও নারীর ভূমিকা নিয়ে উপনিষদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে গেলে আমাদের জীবনের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব।
উপনিষদের দর্শন: সাম্যতার মূল ভিত্তি
উপনিষদে বলা হয়েছে, “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” অর্থাৎ সবই ব্রহ্ম। এই সূত্রটি আমাদের শেখায়, সমস্ত জীব এবং বস্তুতে একই সত্তার উপস্থিতি। তাই, পরিবারে পুরুষ এবং নারীর সমান ভূমিকার গুরুত্ব ঠিক এখান থেকেই শুরু হয়। এটি শুধুমাত্র দায়িত্বের সমান বণ্টনের কথা বলে না, এটি বলে আত্মার সমতার কথাও।
আমি বিশ্বাস করি, আপনি যদি উপনিষদের জ্ঞানকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে পারিবারিক জীবনের মূলমন্ত্র হলো সহযোগিতা। যেমন, “তন্মেধা অমৃতাম” শ্লোকে উল্লেখ আছে, বুদ্ধি ও জ্ঞান পুরুষ এবং নারী উভয়ের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই শিক্ষাটি আমাদের বলে যে, আমরা একে অপরের পরিপূরক এবং একসাথে আমাদের সম্ভাবনাগুলি প্রসারিত করতে পারি।
বাস্তব উদাহরণ: দায়িত্বের ভারসাম্য
- আর্থিক অবদান ও সিদ্ধান্ত:
একটি পরিবারে কেবল পুরুষ অর্থ উপার্জন করবেন এবং নারী ঘর সামলাবেন—এই ধারণা এখন অপ্রাসঙ্গিক। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সুনীল ও তার স্ত্রী মীরা, উভয়েই তাদের পেশাগত জীবন এবং গৃহস্থালির দায়িত্ব সমানভাবে ভাগ করে নিয়েছেন। উপনিষদের “সহ নববতু সহ নবভক্তু” নির্দেশনা অনুসারে, তারা একে অপরকে সমানভাবে সাহায্য করেন। এই সহযোগিতার মাধ্যমে তারা কেবল সংসার চালাচ্ছেন না, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতি করছেন। - সন্তান লালন-পালন:
উপনিষদের শিক্ষা অনুযায়ী, সন্তান লালন-পালনের কাজ পুরুষ ও নারীর যৌথ দায়িত্ব। “মাতৃ দেবো ভব, পিতৃ দেবো ভব” নির্দেশ করে, পিতা ও মাতার ভূমিকা সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমি নিজে একবার একটি দম্পতির গল্প শুনেছিলাম, যেখানে বাবা চাকরির পাশাপাশি সন্তানদের পড়াশোনা দেখতেন এবং মা অফিসের কাজ সামলে নৈশভোজ তৈরি করতেন। এই উদাহরণ আমাদের শেখায় যে, পরিবার তখনই পূর্ণ হয়, যখন উভয়েই নিজেদের অবদান রাখেন। - মানসিক সমর্থন:
পরিবারে মানসিক সমর্থন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উপনিষদে বলা হয়েছে, “আত্মনং বিদ্ধি” অর্থাৎ নিজেকে জানো। যখন আপনি এবং আপনার সঙ্গী একে অপরের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবেন, তখন একটি শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হবে। আমার এক পরিচিত দম্পতি, যারা কঠিন সময়ে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছেন, উপনিষদের এই শিক্ষার সত্যতা প্রমাণ করেছেন।
পুরুষ ও নারীর আত্মিক সমানতা
উপনিষদে উল্লেখ আছে, “পুরুষম্ প্রকৃতিঃ সর্বং”। এটি বোঝায়, পুরুষ এবং প্রকৃতি (নারী) উভয়েই সমানভাবে সৃষ্টির অংশ। পরিবারে পুরুষ ও নারীর ভূমিকা নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের এই শিক্ষাটিকে মনে রাখতে হবে। আমরা যদি নিজেদের আত্মিক শক্তিকে সমানভাবে মূল্য দিই, তবে আমাদের জীবনে শান্তি এবং ভারসাম্য ফিরে আসবে।
সমান ভূমিকার ফলাফল
আপনি যদি পরিবারে সমান ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন, তবে কয়েকটি প্রধান উপকারিতা পাবেন:
- সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি:
পুরুষ ও নারীর মধ্যে সম্মানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা উপনিষদের “সত্যমেব জয়তে” অর্থাৎ সত্যই জয়ী হয়—এই মূলমন্ত্রে উদ্ভাসিত। - সন্তানের উন্নতি:
সন্তানেরা শেখে কিভাবে সমতা ও ন্যায়ের মূল্য দিতে হয়। এটি তাদের ভবিষ্যতের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। - মানসিক শান্তি:
যখন আপনি এবং আপনার সঙ্গী দায়িত্ব ভাগ করে নেন, তখন মানসিক চাপ কমে এবং পারিবারিক জীবন সুখকর হয়।
উপসংহার
উপনিষদের জ্ঞান আমাদের শেখায় যে, পরিবারে পুরুষ এবং নারীর সমান ভূমিকা কেবল প্রয়োজনীয় নয়, এটি আমাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। “আত্মনং মুক্তিঃ” শ্লোকটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আত্মার মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন আমরা সমতা এবং সহযোগিতার নীতি মেনে চলি।