পরিবার হল জীবনের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র। পরিবারের প্রতিটি সদস্যই সুখ-শান্তি রক্ষার জন্য দায়বদ্ধ। আপনিও নিশ্চয়ই ভাবছেন, কীভাবে পরিবারের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা উপনিষদএর জ্ঞান থেকে সাহায্য নিতে পারি।
উপনিষদের দর্শন: পরিবারে সুখের মূলমন্ত্র
উপনিষদ বলছে, “সর্বং ব্ৰহ্ম,” অর্থাৎ সবকিছুই ব্রহ্ম। এই দর্শন আমাদের শেখায় যে পরিবারে প্রত্যেক সদস্যই একে অপরের সাথে সংযুক্ত, যেমন নদী সাগরের সাথে মিশে যায়।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, উপনিষদের এই দর্শন প্রয়োগ করলে আমরা পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বজায় রাখতে পারি। এবার দেখা যাক, পরিবারের সুখ-শান্তি রক্ষায় প্রত্যেকের ভূমিকা কী হতে পারে।
বাবা-মায়ের ভূমিকা: সন্তানদের জীবনের ভিত গড়ে তোলা
বাবা-মা হলেন পরিবারের মূল স্তম্ভ। তাঁদের ভূমিকা শুধুমাত্র সন্তানদের বড় করা নয়, তাদের সঠিক মূল্যবোধ শেখানো।
উপনিষদে বলা হয়েছে:
“মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব।”
এর অর্থ, মাতা-পিতাকে দেবতা রূপে গণ্য করতে হবে। বাবা-মায়ের দায়িত্ব হল নিজেদের আচরণ দিয়ে সন্তানদের সামনে আদর্শ স্থাপন করা। যদি বাবা-মা একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন এবং ভালোবাসা দেখান, সন্তানরা সেই পরিবেশ থেকেই শিখবে।
উদাহরণ:
- প্রতিদিন সকালে পরিবারের সদস্যদের সাথে ধ্যান বা প্রার্থনার মাধ্যমে দিন শুরু করা।
- সন্তানের পড়াশোনা বা সমস্যার সময় ধৈর্য ধরে তাকে সাহায্য করা।
- পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবার মতামত শোনা।
সন্তানদের ভূমিকা: শ্রদ্ধা ও দায়িত্ব পালন
সন্তানরা পরিবারের ভবিষ্যৎ। তাদের ভূমিকা শুধুমাত্র পড়াশোনা বা ক্যারিয়ার গড়ায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং পরিবারে সুখ-শান্তি বজায় রাখতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
উপনিষদে বলা হয়েছে:
“সত্যং ব্ৰূযাত্, ধর্মং চর।”
এর অর্থ, সত্য বলা এবং ধর্ম বা নৈতিকতার পথে চলা। সন্তানদের উচিত বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং নিজেদের দায়িত্ব পালন করা।
উদাহরণ:
- বাবা-মায়ের কথা মন দিয়ে শোনা এবং তাদের নির্দেশ মেনে চলা।
- পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের যত্ন নেওয়া।
- ছোট ভাই-বোনদের সাথে ভালো ব্যবহার করা এবং তাদের গাইড করা।
ভাই-বোনদের ভূমিকা: বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা
ভাই-বোনেরা একে অপরের জীবনের প্রথম বন্ধু। তাঁদের ভূমিকা হল পারস্পরিক সাহায্য করা এবং একে অপরের প্রতি ভালোবাসা বজায় রাখা।
উপনিষদে বলা হয়েছে:
“সহনাববতু, সহনৌ ভুনক্তু।”
এর অর্থ, আমরা একসাথে পড়াশোনা করি এবং একসাথে বেড়ে উঠি। এই মন্ত্র ভাই-বোনদের সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়।
উদাহরণ:
- ছোটবেলার খুনসুটি ভুলে পারস্পরিক সহযোগিতা করা।
- একে অপরের সমস্যা বুঝে সমাধানে সাহায্য করা।
- পারিবারিক বিষয় নিয়ে ঝগড়া না করা।
দাদু-দিদিমার ভূমিকা: জ্ঞানের ভাণ্ডার
বয়স্ক সদস্যরা পরিবারের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। তাঁদের কাছ থেকে জীবনের নানা শিক্ষা পাওয়া যায়।
উপনিষদে বলা হয়েছে:
“অথ যজ্ঞো বীর্যাসমাপ্যতে।”
অর্থাৎ, জীবনের জ্ঞান অর্জন করে সেটি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। দাদু-দিদিমারা তাঁদের গল্প, অভিজ্ঞতা, এবং শিক্ষার মাধ্যমে পরিবারে ভালোবাসা ও ঐতিহ্য বজায় রাখেন।
উদাহরণ:
- নাতি-নাতনিদের গল্প শুনিয়ে তাদের মানসিক উন্নয়নে সাহায্য করা।
- পারিবারিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা করা।
- পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে পরামর্শ দেওয়া।
পরিবারের সক্রিয় যোগাযোগ: সুখের চাবিকাঠি
পরিবারে সুখ-শান্তি বজায় রাখতে যোগাযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। উপনিষদে বলা হয়েছে:
“বসুধৈব কুটুম্বকম।”
অর্থাৎ, পৃথিবীই আমাদের পরিবার। যদি আমরা পরিবারের সদস্যদের সাথে ভালোভাবে যোগাযোগ রক্ষা করি, তাহলে ভুল বোঝাবুঝি ও ঝগড়া অনেক কমে যায়।
উদাহরণ:
- পারিবারিক বৈঠকের সময় সবার মতামত শোনা।
- সমস্যাগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা।
- প্রতিদিন অন্তত একটি সময় একসাথে খাওয়া।
আপনি কীভাবে শুরু করবেন?
পরিবারের সুখ-শান্তি বজায় রাখা আপনার এবং আমার দুজনেরই দায়িত্ব। আসুন, আমরা সবাই মিলে উপনিষদের এই শিক্ষাগুলি জীবনে প্রয়োগ করি। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করলে আমাদের জীবন অনেক বেশি অর্থবহ হবে।
শেষে একটাই প্রশ্ন রাখি: “আপনি আজ থেকে কী পরিবর্তন আনবেন আপনার পরিবারের সুখের জন্য?”