সনাতন ধর্মের মূল দর্শন হল ন্যায়পরায়ণতা। এই ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যই সৃষ্টির নিয়ম ও ধর্মীয় আচরণগুলোর অবতারণা। উপনিষদ, যা ভেদান্তের হৃদয় হিসেবে পরিচিত, আমাদের শেখায় কীভাবে ন্যায় এবং ধর্মকে জীবনে প্রতিষ্ঠা করা যায়। এই প্রাচীন শাস্ত্রের শিক্ষা শুধু ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়, সমগ্র সমাজের জন্য এক আদর্শ।
ন্যায়পরায়ণতার মূল ভিত্তি: ধর্ম
উপনিষদে ন্যায়পরায়ণতার মূলে রয়েছে ধর্ম। ধর্ম মানে শুধুমাত্র আচার-অনুষ্ঠান নয়; এটি হল জীবনের একটি শৃঙ্খলা। উপনিষদ বলে:
“ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ।”
অর্থাৎ, আপনি যদি ধর্মকে রক্ষা করেন, তবে ধর্মও আপনাকে রক্ষা করবে। এখানে ধর্ম বলতে ন্যায়ের পথে থাকা, সত্য কথা বলা এবং অন্যের প্রতি সদ্ভাব দেখানো বোঝানো হয়েছে।
ন্যায় পরায়ণ হতে গেলে প্রথমে নিজের জীবনকে ধর্মের আলোকে পরিচালিত করতে হবে। উপনিষদে বার বার উল্লেখ রয়েছে যে, আত্মার প্রকৃত সত্য উপলব্ধি হল ন্যায়পরায়ণতার প্রথম ধাপ। যদি আমরা আমাদের আত্মাকে চিনতে পারি, তাহলে জীবনে সঠিক এবং ভুলের পার্থক্য বুঝতে সহজ হয়।
ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপায়: উপনিষদের শিক্ষা
১. সত্যের পথে চলা
উপনিষদ বলে:
“সত্যমেব জয়তে, নানৃতম।”
সত্য সর্বদাই বিজয়ী হয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যের পথে চলা মানেই ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।
উদাহরণস্বরূপ, রাজা হরিশচন্দ্রের কথা বলা যায়। তিনি সত্যের পথে থেকে নিজের রাজ্য, পরিবার এবং জীবনের সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য এবং ন্যায়ের জন্য তিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করেন।
২. অহিংসার পালন
“অহিংসা পরমো ধর্মঃ।”
উপনিষদে অহিংসাকে ধর্মের সর্বোচ্চ রূপ বলা হয়েছে। অহিংসা মানে শুধু শারীরিকভাবে ক্ষতি না করা নয়, বরং মনের মধ্যেও কারো প্রতি হিংসা না রাখা।
উদাহরণস্বরূপ, মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের কথা মনে করতে পারো। কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি অহিংসার মাধ্যমে ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন।
৩. সর্বের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি রাখা
“ঈশাবাস্যমিদং সর্বং।”
সৃষ্টির প্রতিটি জীবের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজমান। উপনিষদ এই শিক্ষা দিয়ে বোঝাতে চায় যে, যদি আমরা প্রত্যেকের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি রাখি এবং সবার কল্যাণ চাই, তবে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপনিষদের গল্প: জনকের ন্যায় প্রতিষ্ঠা
রাজা জনকের কথা তো নিশ্চয়ই শুনেছ। তিনি ছিলেন এক যোগী এবং মহান ন্যায়পরায়ণ রাজা। জনক সবসময় তাঁর প্রজাদের মধ্যে ধর্ম এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতেন। একবার এক কঠিন পরিস্থিতিতে, রাজা জনক ঘোষণা করেছিলেন যে, যারা সত্য এবং ন্যায়ের পথে থাকবে, তাদের জন্য রাজ্যের সমস্ত দ্বার খোলা থাকবে। এই নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি তাঁর রাজ্যে সম্প্রীতি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন।
ন্যায় প্রতিষ্ঠার আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা
উপনিষদের এই শিক্ষাগুলো আজকের যুগেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। যখন সমাজে অন্যায় বাড়ে, তখন উপনিষদের সত্য, অহিংসা, এবং ধর্মের শিক্ষা মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সনাতন ধর্মের মূল শিক্ষা মেনে চলা প্রয়োজন।
ধর্মের পথেই শান্তি
উপনিষদে উল্লেখ আছে যে, ধর্মের পথে থেকে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করলেই প্রকৃত শান্তি এবং আনন্দ লাভ হয়। সনাতন ধর্মের আলোকে, ন্যায়পরায়ণতা হল সেই শক্তি যা মানুষকে ঈশ্বরের আরও কাছাকাছি নিয়ে যায়। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে উপনিষদের শিক্ষা গ্রহণ করে ন্যায়ের পথে চলি এবং সমাজে সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করি।
“ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।”