নকশা ও অলংকার পরিধানের সীমা কী হওয়া উচিত বলে মনে করা হয়?

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি সীমারেখা থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে যখন আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নকশা এবং অলংকার পরিধানের কথা ভাবি, তখন সেই সীমা নির্ধারণ করা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আমাদের অলংকার বা পোশাক কি আমাদের আত্মার শান্তি বা মনোযোগকে প্রভাবিত করে? উপনিষদ এই বিষয়ে চমৎকার নির্দেশনা প্রদান করে, যা শুধু আভরণ নয়, বরং আমাদের চিন্তাভাবনা এবং কাজকর্মেরও পথ প্রদর্শক।

 নকশা ও অলংকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য

আপনি যদি গভীরভাবে দেখেন, অলংকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো আমাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করা। কিন্তু এই সৌন্দর্য যদি অন্তরের দিক থেকে না আসে, তাহলে বাইরের জৌলুস আসলে অপ্রয়োজনীয়। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে:
“সত্যং শিবং সুন্দরম।”
অর্থাৎ, সত্য এবং শুদ্ধতায়ই প্রকৃত সৌন্দর্য নিহিত। অতএব, অলংকার পরিধানের সময় আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি যেন কখনোই আমাদের আত্মার সরলতাকে আড়াল না করে।

 সীমা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা

আমাদের সমাজে অলংকার এবং সাজগোজ নিয়ে অতিরিক্ত আকর্ষণের প্রবণতা দেখা যায়। তবে এই চর্চা কখনো কখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যেখানে আমাদের আভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনা এবং আত্মজ্ঞান আড়ালে পড়ে যায়। কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে:
“পরীক্ষ্য লোকান্ কর্মচিতান্ ব্রাহ্মণো।”
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি জীবনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অন্বেষণ করতে চায়, তাকে অবশ্যই ভোগবাদী চেতনা থেকে সরে এসে গভীর আত্মজ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। অতএব, অলংকার পরিধানের ক্ষেত্রেও সীমা থাকা প্রয়োজন যাতে আমাদের মনঃসংযোগ বাইরের চমকপ্রদ জিনিসে হারিয়ে না যায়।

 অলংকারের মাধ্যমে সহজ জীবনযাপন

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আপনি যদি অলংকার পরেন, তবে তা যেন সবসময় সরলতা প্রকাশ করে। উদাহরণস্বরূপ:

  • হীরের দামী গহনা পরার পরিবর্তে সাদামাটা রূপার আংটি ব্যবহার করুন।
  • জমকালো নকশার পোশাকের বদলে সহজ ও আরামদায়ক পোশাক বেছে নিন।
    এতে আপনার ব্যক্তিত্ব যেমন ফুটে উঠবে, তেমনই আপনাকে অহংকারের প্রভাব থেকেও দূরে রাখবে। ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে:
    “ত্যেন তক্তেন ভুঞ্জীথাঃ।”
    অর্থাৎ, ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ করো। অর্থাৎ কম নিয়ে শান্তি খুঁজে নেওয়াই প্রকৃত সুখের পথ।

 আধুনিক জীবনে উপনিষদের শিক্ষা

আপনার কি মনে হয়, আধুনিক জীবনে উপনিষদের এই শিক্ষা প্রাসঙ্গিক? আমার অভিজ্ঞতা বলে, এটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। উদাহরণ হিসেবে, অনেকেই যখন সামাজিক অনুষ্ঠানে সবার চেয়ে বেশি দামী পোশাক বা গহনা পরার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন, তখন তাদের মনস্তাত্ত্বিক চাপ অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে না তারা আসলেই সুখী হন, না তাদের আত্মসম্মান বৃদ্ধি পায়।
মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে:
“নয়মাত্মা বালহীনেন লভ্যঃ।”
অর্থাৎ, এই আত্মা কখনোই দুর্বল ইচ্ছাশক্তি বা অহংকারের মধ্যে অর্জন করা যায় না। তাই আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আপনি কি বাইরের আড়ম্বরকে অগ্রাধিকার দেবেন, নাকি আত্মার উন্নতিকে?

 অলংকার ও নকশার আধ্যাত্মিক দিক

আপনার অলংকার এবং নকশা যদি আপনার আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, তাহলে তা কখনোই অতিরিক্ত মনে হবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেকেই মন্দিরে যাওয়ার সময় তিলক বা পবিত্র মালা ব্যবহার করেন। এটি তাদের আধ্যাত্মিক চেতনার প্রতীক।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে:
“আত্মানং বিদ্ধি।”
অর্থাৎ, নিজেকে জানো। তাই যেকোনো অলংকার বা নকশা নির্বাচন করার সময় নিজেকে প্রশ্ন করুন: এটি কি আমাকে আরও ভালো মানুষ হতে সাহায্য করছে?

 সঠিক মানসিকতা গড়ে তোলা

আপনার অলংকার বা পোশাকের চেয়ে আপনার আচার-ব্যবহারই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একবার আমি এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করছিলাম, যিনি দামী গহনার প্রতি প্রচণ্ড আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি পরে স্বীকার করেন, এই আকর্ষণ তাকে অন্যদের তুলনায় ছোট মনে করিয়ে দিত। কিন্তু যখন তিনি উপনিষদের শিক্ষা গ্রহণ করে সরল জীবনযাপন শুরু করেন, তখনই তিনি প্রকৃত শান্তি লাভ করেন।
কঠ উপনিষদে আরও বলা হয়েছে:
“অভয়ং সর্বত্র বিদ্ধি।”
অর্থাৎ, যেখানে ভয় নেই, সেখানেই প্রকৃত জীবন।

উপসংহার

অতএব, আমরা যদি জীবনে প্রকৃত আনন্দ ও শান্তি খুঁজে পেতে চাই, তবে আমাদের নকশা ও অলংকার পরিধানের ক্ষেত্রে সীমারেখা নির্ধারণ করতে হবে। এটি শুধু আমাদের বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, আমাদের আভ্যন্তরীণ চরিত্রের প্রতিফলনও ঘটাবে। আপনি কি মনে করেন, আপনি আপনার জীবনে এই সীমা নির্ধারণ করতে প্রস্তুত? উপনিষদ আমাদের শিক্ষা দেয়, কম গ্রহণ করেই আমরা বেশি পেতে পারি। তবে এর জন্য প্রয়োজন আত্মজিজ্ঞাসা এবং আত্মার উন্নতি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top