ধ্যান ও যোগের গুরুত্ব কী?

আমরা প্রতিদিন যে জীবনের গতিতে ছুটছি, সেই জীবন কি সত্যিই আমাদের সুখী করছে? আপনার দিনগুলো কি আপনাকে সন্তুষ্ট করছে? আমি নিজেও একসময় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছি। তখনই ধ্যান ও যোগের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমাদের প্রাচীন গ্রন্থ উপনিষদে ধ্যান ও যোগকে জীবনের কেন্দ্রে স্থান দেওয়া হয়েছে। চলুন আজ আমরা একসঙ্গে খুঁজে দেখি ধ্যান ও যোগের গুরুত্ব এবং কীভাবে এটি আমাদের জীবনের মানোন্নয়নে সহায়ক।

ধ্যান: মন এবং আত্মার সংযোগ

ধ্যান বা ধ্যানযোগ, আমাদের অন্তরের এক গভীর যাত্রা। আমরা সবাই জানি, জীবন শুধুমাত্র বাইরের কাজকর্মে সীমাবদ্ধ নয়। বরং, জীবনের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে আমাদের ভেতরের জগতে। উপনিষদ বলে, “মনসৈব পুরুষং প্রাপ্তব্যম্” — শুধুমাত্র মনকে শান্ত করলেই আমরা আত্মার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারি।

আপনার মনে কি কখনো এমন হয়েছে যে আপনি কিছুক্ষণের জন্য সব চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে চান? ধ্যান সেই মুক্তির পথ। একদিন আমি খুব চাপে ছিলাম; অফিসের কাজের চাপে যেন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। ঠিক তখনই আমি প্রথম ধ্যানের শরণ নিয়েছিলাম। মাত্র ১০ মিনিটের ধ্যান আমাকে এমন এক প্রশান্তি এনে দিয়েছিল যা আমি আগে কখনো অনুভব করিনি। ধ্যান শুধু মনের শান্তি নয়, এটি আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি করে।

যোগ: দেহ ও মনের ঐক্য

যোগ শব্দটি এসেছে ‘যুজ’ ধাতু থেকে, যার অর্থ “সংযোগ”। এটি দেহ ও মনের মধ্যে এক সেতুবন্ধন তৈরি করে। উপনিষদে বলা হয়েছে, “যোগঃ চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ” — যোগ হলো মনের পরিবর্তনগুলোর নিয়ন্ত্রণ। আপনি কি জানেন, নিয়মিত যোগচর্চা করলে আমাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়? একবার আমি দীর্ঘদিন ধরে পিঠের ব্যথায় ভুগছিলাম। বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করেও কোনো লাভ হয়নি। তখন একজন বন্ধু আমাকে যোগাভ্যাস শুরু করতে বলেছিলেন। প্রতিদিন ৩০ মিনিট যোগাভ্যাস করার পর, এক মাসের মধ্যে আমি ব্যথা থেকে মুক্তি পাই। এটি শুধুই একটি উদাহরণ।

উপনিষদে ধ্যান ও যোগের ভূমিকা

উপনিষদে ধ্যান ও যোগকে কেবলমাত্র একটি অনুশীলন হিসেবে নয়, জীবনের পথপ্রদর্শক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

  •  ধ্যান: আত্মার সন্ধান উপনিষদে বলা হয়েছে, “অত্মানং বিদ্ধি” — নিজেকে জানো। এই জ্ঞান অর্জনের পথ ধ্যান। প্রতিদিন সকালে মাত্র ১৫ মিনিট ধ্যান করার মাধ্যমে আমরা আমাদের অন্তরাত্মার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারি। এটি আমাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করে এবং আমাদের মধ্যে এক নতুন শক্তি নিয়ে আসে।
  •  যোগ: জীবনের ভারসাম্য উপনিষদে আরও বলা হয়েছে, “সমত্বং যোগ উচ্যতে” — যোগ হলো সমতা। জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতিতে সমানভাবে থাকা, সুখে এবং দুঃখে সমভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো। আমি নিজে যখন যোগাভ্যাস শুরু করি, তখন প্রথমে কিছুটা কঠিন মনে হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি আমার জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠল।

ধ্যান ও যোগের দৈনন্দিন প্রভাব

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, কেন আমরা এত চাপ অনুভব করি? তার প্রধান কারণ হলো আমাদের মন সবসময় অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে ঘুরপাক খায়। ধ্যান এবং যোগ আমাদের এই অভ্যাস থেকে মুক্তি দেয়।

  • মনোযোগ বৃদ্ধি: আমি লক্ষ্য করেছি, ধ্যান আমার মনোযোগ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। যখন কাজ করি, তখন সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারি।
  • চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি: যোগ চর্চার মাধ্যমে আমার চিন্তাধারা আরও সুস্পষ্ট হয়েছে।
  • শরীরের নমনীয়তা: দৈনন্দিন যোগাভ্যাস আমাকে শারীরিকভাবে শক্তিশালী ও নমনীয় করে তুলেছে।

ধারণা করুন, আপনি একদিন সকালে উঠে যোগাসন করছেন এবং তারপর এক কাপ চা নিয়ে ধ্যান করছেন। সেই প্রশান্তি এবং আনন্দের অনুভূতিটি কি আপনি কল্পনা করতে পারেন?

অন্যদের অনুপ্রেরণা দানের উপায়

ধ্যান ও যোগ শুধুমাত্র আমাদের জন্য নয়, আমাদের চারপাশের মানুষদের জন্যও উপকারী। আমি আমার পরিবারে ধ্যান এবং যোগ চালু করেছি। এটি আমার পরিবারকে একত্রিত করেছে। আমরা সকলে সকালে একসাথে ধ্যান করি এবং এটি আমাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছে।

একজন শিক্ষকের কাছে শুনেছিলাম, তিনি তার ছাত্রদের ধ্যানের গুরুত্ব শেখান। তাদের একাগ্রতা বেড়ে গেছে এবং পরীক্ষার ফলাফলও ভালো হয়েছে।

ধ্যান ও যোগে জীবনযাত্রার পরিবর্তন

উপনিষদে বলা হয়েছে, “সন্তোষম্ পরম সুখম্” — সন্তোষ হলো পরম সুখ। ধ্যান এবং যোগ এই সন্তোষ অর্জনের পথ। এটি কেবল আমাদের মনকে শান্ত করে না, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তন করে। আমরা জীবনের প্রতি আরও কৃতজ্ঞ হয়ে উঠি।

শেষ কথায় ভাবনার আহ্বান

ধ্যান এবং যোগ কেবল একটি অভ্যাস নয়; এটি আমাদের জীবনের দর্শন। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আপনার জীবনের উদ্দেশ্য কী? আপনি কি আত্মার সাথে সংযোগ স্থাপন করেছেন? উপনিষদের এই শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, “যা অতীত, যা বর্তমান, যা ভবিষ্যৎ — সবকিছু আত্মাতেই নিহিত।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top