আমাদের জীবনের লক্ষ্য কী? শুধুই ধনসম্পত্তি অর্জন নাকি এর পেছনে আরও গভীর কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে? আমি নিশ্চিত, আপনি হয়তো ভাবছেন যে জীবনে টাকা-পয়সা জরুরি। কিন্তু উপনিষদের শাশ্বত শিক্ষার আলোকে আমরা যদি দেখি, তবে প্রশ্ন জাগে—এই ধনসম্পত্তি যদি নৈতিকতার সঙ্গে না আসে, তাহলে কি তা সত্যিই মূল্যবান?
আমি যখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসেছিলাম, উপনিষদের একটি উদ্ধৃতি বারবার মনে এসেছে—“সত্যমেব জয়তে নানৃতং” (মুন্ডক উপনিষদ ৩.১.৬)। সত্যই জয়ী হয়, অসত্য নয়। কিন্তু সত্যমার্গে থেকে ধনসম্পত্তি অর্জন কি সম্ভব? চলুন, আমরা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি।
ধনসম্পত্তি ও নৈতিকতার পারস্পরিক সম্পর্ক
ধনসম্পত্তি উপার্জন জীবনের প্রয়োজনীয় এক অংশ। তবে আপনি কি কখনো ভেবেছেন, যে ধন শুধুমাত্র প্রতারণা, মিথ্যা বা অন্যের ক্ষতির মাধ্যমে অর্জিত হয়, তা আসলে দীর্ঘস্থায়ী হয় না? এখানে উপনিষদের আরেকটি শিক্ষা প্রাসঙ্গিক—“তৈন তক্তৈন ভুঞ্জীথা, মা গৃহঃ কস্যস্বিদ্ ধনম্” (ঈশোপনিষদ ১)। এর অর্থ হলো, যা আপনার প্রাপ্য তা উপভোগ করুন, কিন্তু অন্যের সম্পত্তির প্রতি লোভ করবেন না।
আমার নিজের জীবনে একটি উদাহরণ মনে পড়ছে। একবার একজন ব্যবসায়ী বন্ধুকে দেখেছিলাম, যিনি প্রতারণার মাধ্যমে বড় লাভ করেছিলেন। প্রথমে মনে হয়েছিল তিনি অনেক সফল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই অবৈধ ধনসম্পত্তি তার জীবনে অশান্তি আর দুর্ভোগ ডেকে এনেছিল। তার সম্পর্কে, ব্যবসায়িক অংশীদার আর সমাজের বিশ্বাস ভেঙে পড়েছিল। এতে আমি শিখেছি—নৈতিকতা ছাড়া অর্জিত ধন কেবলই বোঝা।
উপনিষদের আলোকে ধনসম্পত্তি উপার্জনের চার নীতি
- সত্য ও ধর্ম মেনে চলা:
উপনিষদে বলা হয়েছে, “ধর্মেণ হীনা পশুভিঃ সমানা”—ধর্মহীন ব্যক্তি পশুর সমান। আপনি যদি ধনসম্পত্তি অর্জনে সত্য ও ধর্মের পথ ছেড়ে দেন, তাহলে জীবনের প্রকৃত মূল্য হারিয়ে ফেলবেন। - নিজ দায়িত্ব পালন করা:
“স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পরধর্মো ভয়াবহঃ” (ভগবদ্গীতা ৩.৩৫)—যদিও এটি গীতার বাণী, তবে উপনিষদের নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি শেখায়, নিজের দায়িত্ব ও কাজ সৎভাবে করা উচিত। - পরিশ্রম ও ধৈর্যের মূল্য:
কেথোপনিষদে বলা হয়েছে, “উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত” (১.৩.১৪)। জাগ্রত হও, পরিশ্রম কর, এবং নিজের সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাও। ধনসম্পত্তি অর্জনে যদি কঠোর পরিশ্রম এবং ধৈর্যের ভূমিকা থাকে, তবে তা নৈতিকতার পথে আসে। - সংযম ও ত্যাগের আদর্শ:
ধনসম্পত্তি উপার্জনে আপনার লোভ যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে, **“ত্যাগেন ভুঞ্জীথাঃ”—ত্যাগের মাধ্যমে জীবনের আসল আনন্দ খুঁজে পান।
নৈতিকতার অভাব কীভাবে ক্ষতি ডেকে আনে?
আপনার হয়তো মনে হতে পারে, কিছুটা প্রতারণা বা অনৈতিক কাজ করলে ক্ষতি কী? তবে উপনিষদে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, “অসত্যেন রজস্তমঃ”—অসত্যের পথ মানসিক অস্থিরতা আর অন্ধকার নিয়ে আসে।
ধরুন, আপনি একজন চাকুরিজীবী। অফিসে আপনার সততার জন্য সবাই আপনাকে সম্মান করে। একদিন হঠাৎ আপনি একটি প্রলোভনে পড়ে অফিসের কোনো নিয়ম ভেঙে দেন। আপনার সুনাম তখন মুহূর্তেই ধ্বংস হতে পারে। এমন ঘটনা আমাদের চারপাশে অহরহ ঘটে।
নৈতিকতার সঙ্গে ধনসম্পত্তি উপার্জনের ৩টি উদাহরণ
- হর্ষবর্ধনের শাসন:
প্রাচীন ভারতের রাজা হর্ষবর্ধন সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে শাসন করেছিলেন। তার রাজ্যে কেউ দারিদ্র্যের শিকার হতেন না, কারণ তিনি নৈতিকতার সঙ্গে প্রজাদের সহায়তা করতেন। - মহাত্মা গান্ধীর জীবনী:
গান্ধীজী তার সারা জীবন সত্য ও অহিংসার পথে চলেছেন। তার শিক্ষা ছিল, “অহিংসা পরম ধর্ম,” যা আমরা উপনিষদের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত দেখতে পাই। - আধুনিক সমাজে সৎ ব্যবসায়ী:
আজকের যুগে অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা সৎ পথে ব্যবসা করে সফল হয়েছেন। তারা শুধু নিজেরাই ধনী হননি, সমাজের উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছেন।
আপনার জীবনে নৈতিকতার ভূমিকা কীভাবে বাড়াবেন?
আপনার জীবনে নৈতিকতার গুরুত্ব বাড়াতে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন:
- সৎ থাকা: প্রতিদিন ছোট ছোট সিদ্ধান্তে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকুন।
- ধ্যান চর্চা: ধ্যানের মাধ্যমে নিজের মনের অস্থিরতা কমান।
- উপনিষদের শিক্ষা গ্রহণ: নিয়মিত উপনিষদের শিক্ষাগুলো পড়ুন ও তা জীবনে প্রয়োগ করুন।
শেষ কথা
ধনসম্পত্তি উপার্জন জীবনের একটি অংশ, তবে এটি নৈতিকতার সঙ্গে হতে হবে। উপনিষদের শিক্ষা আমাদের দেখায় যে, ধনসম্পত্তি যদি সত্য, ধর্ম এবং ন্যায়ের পথ ধরে অর্জিত হয়, তবে তা আমাদের জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনে।
আপনারা কি মনে করেন, জীবনের প্রকৃত আনন্দ কি কেবল ধনের মধ্যে? নাকি এটি নৈতিকতার সঙ্গে অর্জিত জীবনযাত্রার ফল? উপনিষদের একটি প্রশ্ন দিয়ে শেষ করি—“কস্মিন্ নু ভবতি বিদিতম্?” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ)—তুমি সত্যকে জানতে কখন সচেষ্ট হবে?