দুঃখ ও কষ্ট মোকাবিলায় কী পরামর্শ দেয়?

দুঃখ ও কষ্ট মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে দুঃখ, হতাশা, বা কষ্টের সম্মুখীন হই। কিন্তু এই প্রতিকূলতাগুলোকে কীভাবে সামলাবো? উপনিষদে বলা হয়েছে, জীবনকে উন্নত করার জন্য আমাদের দুঃখ ও কষ্টকে বোঝা এবং সঠিকভাবে মোকাবিলা করা জরুরি। আমি এই লেখায় আমার অভিজ্ঞতা এবং উপনিষদের মন্ত্রগুলোকে ভিত্তি করে কিছু উপদেশ তুলে ধরছি যা আপনাকে দুঃখ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে।

 দুঃখকে বোঝার চেষ্টা করো

উপনিষদে বলা হয়েছে:
“অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়।”
অর্থাৎ, আমাদেরকে মিথ্যা থেকে সত্যের দিকে এবং অন্ধকার থেকে আলোতে যেতে হবে। দুঃখ আমাদের জীবনের একটি শিক্ষা হতে পারে। একবার আমি চাকরি হারানোর কারণে হতাশ হয়েছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল সব কিছু শেষ। কিন্তু পরে বুঝলাম, এই ঘটনার মাধ্যমে আমি নিজের দক্ষতাগুলো আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি এবং একটি নতুন সুযোগ খুঁজে পেয়েছি। এই অভিজ্ঞতা আমাকে আরও শক্তিশালী করেছে।

আপনার জীবনে এমন কোনো দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে, সেটিকে একধরনের পাঠ হিসেবে গ্রহণ করুন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: “এই পরিস্থিতি থেকে আমি কী শিখতে পারি?”

 ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ করো

উপনিষদ বলে:
“শ্রদ্ধা, সমাধি এবং যোগ সাধনার মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করো।”
যখন আমরা কষ্টে থাকি, তখন মন প্রায়শই অস্থির হয়ে পড়ে। আমি একবার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পড়েছিলাম। সেই সময়ে আমার একমাত্র সমাধান ছিল ধ্যান। প্রতিদিন সকালে ১০ মিনিট ধরে গভীর শ্বাস নেওয়া এবং নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করতাম। এটি আমাকে আমার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করেছিল।

আপনিও যদি মানসিক কষ্টে ভুগেন, তাহলে প্রতিদিন কিছুটা সময় ধ্যানের জন্য বরাদ্দ করুন। এটি আপনার মনকে শান্ত করবে এবং আপনাকে আরও সংযত হতে সাহায্য করবে।

 আত্মাকে চিনতে শিখুন

উপনিষদে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উক্তি হলো:
“আত্মানং বিদ্ধি।”
অর্থাৎ, “নিজের আত্মাকে জানো।” আমাদের দুঃখের মূল কারণ প্রায়ই আমাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা এবং ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা। উপনিষদে বলা হয়েছে, আমাদের প্রকৃত সত্তাকে জানলে দুঃখ আর দুঃখ থাকবে না।

আমি একবার এমন একটি পরিস্থিতিতে ছিলাম যখন নিজের সঙ্গে অসন্তুষ্ট ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যা করছি, তা যথেষ্ট নয়। তখন আমি উপনিষদের এই মন্ত্রটি হৃদয়ে ধারণ করি। ধীরে ধীরে নিজের শক্তি, দুর্বলতা এবং প্রকৃত লক্ষ্যগুলো বুঝতে পারি। এর ফলে আমি জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করতে শুরু করি।

আপনারও উচিত নিজের ভেতর প্রবেশ করা, আপনার আত্মাকে চেনা, এবং বুঝতে চেষ্টা করা যে দুঃখ আপনার প্রকৃত সত্তাকে স্পর্শ করতে পারে না।

 সঙ্গ দোষ এবং সঙ্গ গুণ

উপনিষদে বলা হয়েছে:
“সঙ্গস্য শক্তিরূপিনী।”
অর্থাৎ, আপনার সঙ্গ আপনাকে গড়ে তোলে। যদি আপনি এমন পরিবেশে থাকেন যেখানে নেতিবাচকতা প্রচুর, তাহলে তা আপনার মানসিক অবস্থাকে খারাপ করে তুলবে। আমি একবার এমন একটি দলে ছিলাম যেখানে প্রায় সবাই নিজের সমস্যাগুলো নিয়ে অভিযোগ করত। এতে আমার মনেও নেতিবাচক চিন্তা বেড়ে গিয়েছিল। পরে, আমি জীবনে ইতিবাচক এবং অনুপ্রেরণাদায়ক মানুষদের সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করি। এটি আমার জীবনের মানসিক ভারসাম্য ফেরাতে সাহায্য করেছিল।

আপনার জীবনেও যদি নেতিবাচক পরিবেশ থাকে, তাহলে তা বদলানোর চেষ্টা করুন। ইতিবাচক মানুষ এবং চিন্তাগুলোর সংস্পর্শে থাকুন।

 দুঃখের সাময়িকতা উপলব্ধি করো

উপনিষদে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো:
“সর্বং দুখং অণিত্যং।”
অর্থাৎ, “সব দুঃখই সাময়িক।” এই শিক্ষাটি আমাকে অনেকবার শক্তি জুগিয়েছে। একবার আমি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল, আমি আর সুস্থ হব না। কিন্তু এই উপনিষদের কথাটি মনে করে বুঝতে পারলাম, এই দুঃখও একদিন কেটে যাবে। সত্যিই, ধৈর্য এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম।

আপনাকেও এটি মনে রাখতে হবে: কোনো দুঃখ স্থায়ী নয়। এটি সময়ের সঙ্গে পাল্টে যাবে।

 অন্যদের সাহায্য করো

উপনিষদে বলা হয়েছে:
“পরার্থং জীবনং।”
অর্থাৎ, “অন্যদের জন্য জীবন যাপন করো।” যখন আমরা কষ্টে থাকি, তখন নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু উপনিষদ শিক্ষা দেয়, নিজের দুঃখ ভুলে অন্যের পাশে দাঁড়ালে আমাদের মন নিজেই শান্তি পায়। আমি একবার এক বৃদ্ধাশ্রমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছিলাম। তাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে দেখলাম, আমার দুঃখ যেন লাঘব হয়েছে।

যখন আপনি নিজেকে খুব একা বা অসহায় মনে করবেন, তখন অন্যদের সাহায্য করার চেষ্টা করুন। এটি আপনার মনকে নতুন শক্তি দেবে।

উপসংহার

দুঃখ এবং কষ্ট আমাদের জীবনের অংশ। কিন্তু উপনিষদের শিক্ষা আমাদের দেখায়, কীভাবে এই প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে জীবনে উন্নতি করা যায়। আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন রেখে শেষ করতে চাই:
“আপনার জীবনের কোন দুঃখটি আপনাকে সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিয়েছে?”

উত্তর খুঁজতে গিয়ে আপনি হয়তো নতুন কিছু শিখতে পারবেন এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে পারবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top