দারিদ্র্য দূরীকরণে উপনিষদের কোনো নির্দেশনা আছে কি?

দারিদ্র্য দূরীকরণে উপনিষদের কোনো নির্দেশনা আছে কি?

উপনিষদের জ্ঞান: মানবজীবনের দারিদ্র্য দূর করার মহৌষধ

বন্ধুরা, জীবন আমাদের কাছে নানা রকম চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। তার মধ্যে অর্থনৈতিক দারিদ্র্য হলো সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি। দারিদ্র্য শুধু অর্থের অভাব নয়, এটি মন, মস্তিষ্ক ও আত্মার শক্তি হ্রাসেরও একটি প্রতিচ্ছবি। উপনিষদ আমাদের শিখিয়েছে যে, প্রকৃত দারিদ্র্য হলো জ্ঞানের অভাব। তাই, আজ আমরা একসঙ্গে খুঁজে দেখব—উপনিষদের জ্ঞান কীভাবে আমাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে।

উপনিষদের দর্শন: দারিদ্র্যের মূল কারণ

আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন যে আমাদের জীবনে দারিদ্র্য কেন আসে? অর্থের অভাব তো একটা কারণ, তবে এটি কি একমাত্র কারণ? উপনিষদ বলে—
“যথা মনঃ তথা বাণী, যথা বাণী তথা ক্রিয়া।”
অর্থাৎ, আমাদের মন যেমন ভাবে, আমাদের কথা ও কর্মও তেমনই হয়। আমরা যদি সর্বদা নিজেদের অক্ষম, পরাজিত ও দারিদ্র্যপীড়িত মনে করি, তবে আমাদের জীবনে কখনোই সমৃদ্ধি আসবে না। তাই প্রথমে আমাদের মনকে মুক্ত করতে হবে।

উপনিষদে বলা হয়েছে, “তন্মাত্রা শক্তিঃ”—আমাদের চেতনা এবং আত্মার শক্তিই হলো সবকিছুর মূল। আত্মশক্তিকে উপলব্ধি করতে পারলে আমরা যে কোনো পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।

১. ‘আত্মশক্তি’-র বিকাশ: ইশোপনিষদের শিক্ষা

ইশোপনিষদে বলা হয়েছে:
“ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।”
অর্থাৎ, এই জগৎ ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছাদিত। প্রকৃতি আমাদের যা কিছু দিয়েছে, তার সঠিক ব্যবহার করতে পারলেই আমরা আমাদের জীবন সমৃদ্ধ করতে পারি। এখানে একটি শিক্ষা পাওয়া যায়—লোভ-লালসার বদলে সংযম ও সঠিক ব্যবস্থাপনা আমাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে।

আপনি কীভাবে এই ধারণা প্রয়োগ করবেন? ধরুন, আপনি সীমিত আয়ের মধ্যে আছেন। সঠিক পরিকল্পনা ও সংযমের মাধ্যমে আপনি ধীরে ধীরে আপনার অর্থের সঞ্চয় বাড়াতে পারবেন।

২. জ্ঞানের শক্তি: ছান্দোগ্য উপনিষদ

ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে:
“সত্যমেব জয়তে নানৃতম্।”
অর্থাৎ, সত্যের পথেই জয় আসে। দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য আমাদের প্রথমে সত্যকে গ্রহণ করতে হবে। সত্য মানে কী? এটি শুধু সততা নয়, নিজের জীবনের উদ্দেশ্যকে জানা এবং সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করা।

একবার একজন ব্রাহ্মণ তার পুত্রকে পাঠালেন গুরুগৃহে জ্ঞান অর্জনের জন্য। ফিরে এসে পুত্র বলল, “বাবা, আমি কিছুই শিখিনি।” বাবা বললেন, “তুমি কি জানো, আত্মা কী?” সেই পুত্র যখন আত্মজ্ঞান লাভ করল, তখন সে বুঝতে পারল, প্রকৃত ধন সম্পদ বাইরে নয়, বরং ভেতরে। এই আত্মজ্ঞান তাকে মহাজ্ঞানী ও ধনবান করেছিল।

আমাদেরও দরকার সেই আত্মজ্ঞান—নিজের শক্তিকে চেনা ও কাজে লাগানো।

৩. কর্ম ও উপার্জন: কঠোপনিষদের শিক্ষা

কঠোপনিষদে একটি গল্প আছে নচিকেতার। নচিকেতা যখন মৃত্যুর দেবতা যমের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেছিল, “মৃত্যুর পর কী হয়?” তখন যম তাকে বলেন:
“উত্তিষ্ঠত। জাগ্রত। প্রাপ্য বরান্নিবোধত।”
অর্থাৎ, ওঠো, জাগো, এবং নিজের লক্ষ্য পূরণ করো। এটি আমাদের শেখায় যে কর্ম ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব নয়। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের কর্মঠ হতে হবে এবং সৎপথে উপার্জন করতে হবে।

একবার এক গ্রামে একজন কৃষক ছিলেন, যিনি দিনরাত পরিশ্রম করতেন। তার বন্ধুরা তাকে বলত, “তোমার জীবন তো বড় কষ্টের!” কৃষক বললেন, “কষ্ট নয়, আমি আমার কর্মকে আনন্দ মনে করি।” তার পরিশ্রম একদিন তাকে গ্রামের সবচেয়ে সমৃদ্ধ কৃষক বানিয়েছিল।

৪. ত্যাগের মহিমা: বृहদারণ্যক উপনিষদ

উপনিষদে বলা হয়েছে:
“ত্যাগেন ভুঞ্জীথা।”
অর্থাৎ, ত্যাগের মাধ্যমেই প্রকৃত ভোগ সম্ভব। কীভাবে? এটি মানে অপ্রয়োজনীয় লোভ ছেড়ে দিয়ে প্রকৃত প্রয়োজন পূরণের জন্য কাজ করা।

আমাদের জীবনে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে অর্থ ব্যয় হয়। যদি আমরা সংযমী হই এবং মিতব্যয়িতা অবলম্বন করি, তবে ধীরে ধীরে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে।

৫. আশার শক্তি: মুণ্ডক উপনিষদের নির্দেশ

মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে:
“দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া।”
এই শ্লোক দুই পাখির কথা বলে। একটি পাখি ফল খায়, আর অন্যটি তা দেখে। এখানে একটি গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে। আমাদের জীবনেও দুটি দিক রয়েছে—একটি হলো আমাদের কর্ম, আরেকটি হলো আমাদের লক্ষ্য।

যদি আমরা শুধু ফলের পেছনে দৌড়াই, তবে অস্থির হয়ে যাব। কিন্তু যদি আমাদের লক্ষ্য স্থির রাখি এবং প্রতিটি কর্ম সৎভাবে করি, তবে দারিদ্র্য কখনই আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না।

সমৃদ্ধির পথ আত্ম-উপলব্ধিতে

বন্ধুরা, দারিদ্র্য কোনো অভিশাপ নয়। এটি আমাদের আত্ম-উপলব্ধির অভাবের ফল। উপনিষদ আমাদের দেখায় যে, প্রকৃত সমৃদ্ধি আসে আত্মজ্ঞান, সংযম ও সৎ কর্মের মাধ্যমে। আপনার ভেতরেই আছে অসীম শক্তি, সেই শক্তিকে জাগিয়ে তুলুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top