দাম্পত্য জীবন আমাদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমরা সকলেই সুখী ও পরিপূর্ণ দাম্পত্য জীবনের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় আমরা দেখতে পাই যে সম্পর্কের মাধুর্য ফিকে হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হয়? কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলুন, আমরা উপনিষদের জ্ঞানের আলোয় নিজেদের পথ দেখাই।
উপনিষদের দৃষ্টিতে দাম্পত্য জীবন
উপনিষদ বলছে, সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা। “সত্যমেব জয়তে”—এই বাক্যটি আমাদের শেখায় যে, সত্য ও আন্তরিকতাই সম্পর্ককে মজবুত করে। আপনি এবং আপনার জীবনসঙ্গী যদি সত্য ও স্বচ্ছতার সঙ্গে একে অপরের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেন, তবে সম্পর্কের ভিত দৃঢ় হয়।
উপনিষদে বলা হয়েছে:
“যথা পিণ্ডে তথা ব্রহ্মাণ্ডে।”
এটি বোঝায় যে, আমাদের অন্তর্দৃষ্টি ও মনোভাব যেমন, তেমনি আমাদের বাইরের জীবন। আপনার মনে যদি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ভাব থাকে, তবে তা আপনার সম্পর্কেও প্রতিফলিত হবে।
সুখী দাম্পত্য জীবনের ৩টি মূল স্তম্ভ
১. পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া
শ্রদ্ধা সম্পর্কের প্রথম শর্ত। আমরা প্রায়শই ছোটখাটো বিষয়ে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দিতে চাই, যা সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি করে। অথচ উপনিষদ আমাদের শেখায়:
“মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব।”
এখানে মা ও বাবাকে দেবতার মতো সম্মান করার কথা বলা হয়েছে। এই নীতি দাম্পত্য জীবনেও প্রযোজ্য। আপনার সঙ্গীকেও ঠিক তেমনই সম্মান দিন। তার ভাবনা, স্বপ্ন ও ইচ্ছাকে মূল্য দিন।
উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনার সঙ্গী একটি নতুন চাকরির সুযোগ নিতে চান, যা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি তাকে সমর্থন করেন এবং তার চেষ্টাকে স্বীকৃতি দেন, তবে সে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
২. মনের মিল এবং যোগাযোগ বজায় রাখা
উপনিষদে বলা হয়েছে:
“সংগচ্ছধ্বং, সং বধ্বং, সং ভোটমনসিঞ্জনাতাম।”
অর্থাৎ, আমরা একসঙ্গে চলব, একসঙ্গে কথা বলব এবং একসঙ্গে চিন্তা করব। এই বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে একে অপরের সঙ্গে খোলামেলা যোগাযোগ থাকা খুব জরুরি।
উদাহরণস্বরূপ, প্রতিদিন কিছু সময় নির্ধারণ করুন, যেখানে শুধু আপনারা দু’জন নিজেদের অনুভূতি ভাগ করে নেবেন। এটি একটি সহজ অভ্যাস, যা দাম্পত্য জীবনে গভীরতার অনুভূতি আনে।
৩. ত্যাগ ও সমঝোতার মানসিকতা
উপনিষদে আমরা পাই:
“ত্যাগেন ভুঞ্জিথাঃ।”
অর্থাৎ, ত্যাগের মধ্যেই আসল সুখ। দাম্পত্য জীবনে সবসময় নিজের স্বার্থ দেখলে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে।
ধরা যাক, আপনার সঙ্গী একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যেতে চান, অথচ আপনি খুব একটা আগ্রহী নন। তবু যদি আপনি তাকে খুশি করতে সেখানে যান, তবে আপনার এই ত্যাগ সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।
উপনিষদের আলোকে সম্পর্কের আরও কিছু শিক্ষা
১. দাম্পত্যে ধৈর্য ধরুন
উপনিষদে বলা হয়েছে:
“ধৈর্যং পরমং তপঃ।”
অর্থাৎ ধৈর্যই শ্রেষ্ঠ তপস্যা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধৈর্য ধরে এগিয়ে গেলে সাফল্য অর্জন সম্ভব। একইভাবে দাম্পত্য সম্পর্কেও ধৈর্য অপরিহার্য। ঝগড়া বা মতবিরোধ হলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না দিয়ে শান্ত মনে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করুন।
২. একে অপরকে ভালোবাসুন নিঃস্বার্থভাবে
“আত্মবত্ সর্বভূতেষু।”
এই উক্তি অনুযায়ী, প্রত্যেককে নিজের মতো করে ভালোবাসতে শেখা উচিত। আপনার সঙ্গীর প্রতি ভালোবাসা যেন নিঃস্বার্থ ও শর্তহীন হয়। এই ভালোবাসা সম্পর্ককে আরো গভীর করে।
৩. প্রকৃতিকে প্রাধান্য দিন
উপনিষদ আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকার শিক্ষা দেয়। যদি সম্ভব হয়, আপনার সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটান প্রকৃতির কোলে। এতে মন ও মনন সতেজ থাকে এবং দাম্পত্য জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ব্যক্তিগত উদাহরণ ও বাস্তব প্রয়োগ
আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তার দাম্পত্য জীবনে উপনিষদের শিক্ষা ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছেন। তিনি এবং তার স্ত্রী প্রতিদিন সকালে একসঙ্গে যোগব্যায়াম করেন, যা তাদের মধ্যে গভীর মানসিক সংযোগ তৈরি করেছে।
আরেকটি উদাহরণ, এক দম্পতি প্রতি মাসে একদিন ‘ধন্যবাদ দিবস’ পালন করেন। সেদিন তারা পরস্পরের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এটি তাদের সম্পর্কের ইতিবাচকতা বাড়িয়েছে।
উপসংহার
উপনিষদ আমাদের দাম্পত্য জীবনে একটি অনন্য পথ দেখায়, যেখানে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ভালোবাসা ও সমঝোতার মাধ্যমে সম্পর্ককে মজবুত করা যায়।