দাম্পত্য জীবন মানে একসাথে পথচলা। কিন্তু এই পথচলার মাঝে কখনো কখনো ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব বা বিরোধ দেখা দিতে পারে। এই সমস্যা কি অমীমাংসিত থাকতে পারে? না, অবশ্যই না। আমাদের প্রাচীন উপনিষদগুলি দাম্পত্য জীবনের এই সমস্যাগুলোর মর্মে গিয়ে সমাধানের পথ দেখিয়েছে। আমি আজ আপনাকে উপনিষদের আলোকে কিছু সহজ ও কার্যকর উপায় বলব, যা আপনার দাম্পত্য জীবনকে আরও সুন্দর করতে পারে।
দাম্পত্য জীবনে ঈর্ষা কেন আসে?
ঈর্ষা অনেক সময় আমাদের অপ্রাপ্তি থেকে জন্ম নেয়। যখন আমরা মনে করি যে আমাদের সঙ্গী আমাদের চেয়ে বেশি কিছু পেয়েছেন বা আমরা যথেষ্ট মনোযোগ পাচ্ছি না, তখন ঈর্ষা ধীরে ধীরে আমাদের মনে জায়গা করে নেয়। উপনিষদে ঈর্ষার কারণ হিসেবে আমাদের মনের অস্থিরতাকে উল্লেখ করা হয়েছে। মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে:
“যথা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রেণ প্রভিশন্তি নামৃতা; যথা বিদ্বান্ উত্পন্নং অতঃ সংসারং ত্যজতি।”
অর্থাৎ, যেমন নদীগুলি সমুদ্রে প্রবেশ করে নিজেদের পরিচয় হারিয়ে ফেলে, তেমনি জ্ঞানী ব্যক্তি সমস্ত সংকীর্ণতাকে ত্যাগ করেন। ঈর্ষা ত্যাগের মাধ্যমেই দাম্পত্য জীবনে শান্তি ফিরে আসে।
সমাধানের প্রথম ধাপ: নিজের অনুভূতি স্বীকার করুন
আপনি যদি অনুভব করেন যে আপনার মধ্যে ঈর্ষার বীজ গজাচ্ছে, তাহলে প্রথম ধাপ হলো সেটা স্বীকার করা। আমি নিজেও যখন দাম্পত্য জীবনে দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়েছি, তখন দেখেছি সৎভাবে অনুভূতি স্বীকার করার মাধ্যমে সমাধান অনেক সহজ হয়।
কঠোপনিষদে বলা হয়েছে:
“যো ভাবতী স মহতী, যঃ ত্যজতি স পুণ্যভাগ।”
যিনি নিজেকে সত্যভাবে প্রকাশ করেন, তিনিই মহৎ। নিজের অনুভূতি সঙ্গীর সাথে ভাগ করে নিলে আপনাদের মধ্যে বোঝাপড়া আরও বাড়বে।
সঙ্গীর প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখুন
আপনার সঙ্গীর প্রতি শ্রদ্ধা রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমরা শ্রদ্ধা হারাই, তখনই ছোট ছোট বিষয় বড় হয়ে ওঠে। আমি জানি, এটা সব সময় সহজ নয়। কিন্তু উপনিষদে বারবার শ্রদ্ধার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে:
“মধুবাতা ঋতায়তে মধুক্ষরন্তি সিন্দবঃ।”
শ্রদ্ধার মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি সম্পর্ক মধুর হয়ে ওঠে। দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। আপনার সঙ্গী যে ভালো কাজগুলি করেন, সেগুলোর জন্য তাঁকে প্রশংসা করুন। এতে ঈর্ষার জায়গায় ভালোবাসা বাড়বে।
একটি ছোট্ট ঘটনা
একবার আমার এক বন্ধুর দাম্পত্য জীবনে বড় ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। তাদের মধ্যে ঈর্ষা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তারা আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিল। তখন আমি তাদের উপনিষদের এই শিক্ষা ভাগাভাগি করেছিলাম:
“সত্যমেব জয়তে নানৃতম্।” (মুন্ডক উপনিষদ)
তাদের বলেছিলাম, সৎভাবে নিজেদের সমস্যাগুলো আলোচনা করো। ফলস্বরূপ, তারা একে অপরকে দোষারোপ করা বন্ধ করল এবং শান্তির পথ খুঁজে পেল।
ক্ষমাশীল মনোভাব তৈরি করুন
আপনার সঙ্গী যদি কোনো ভুল করেন, তাকে ক্ষমা করুন। উপনিষদে ক্ষমাকে জীবনের অন্যতম গুণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ঈর্ষা দূর করার একটি বড় উপায় হলো ক্ষমাশীল হওয়া। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে:
“যদা সর্বে প্রভিদ্যন্তে হৃদয়স্যেহ গ্রন্থয়ঃ।”
যখন আমরা আমাদের হৃদয়ের সমস্ত গোঁড়ামি কাটিয়ে উঠি, তখনই প্রকৃত শান্তি আসে।
প্রতিদিন একসাথে ধ্যান করুন
ধ্যান দাম্পত্য জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমি আর আমার সঙ্গী প্রতিদিন সকালে ১০ মিনিট একসাথে ধ্যান করি। এতে আমাদের মনের অস্থিরতা কমে এবং আমরা আরও সংযোগ অনুভব করি। আপনি যদি শুরু করতে চান, তবে উপনিষদের এই মন্ত্রটি উচ্চারণ করতে পারেন:
“ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাত্ পূর্ণমুদচ্যতে।”
এই মন্ত্র আপনার মনকে শান্ত করবে এবং সম্পর্ককে গভীরতর করবে।
শেষ কথা
দাম্পত্য জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করতে হলে আমাদের অন্তরের সংকীর্ণতাকে ত্যাগ করতে হবে। ঈর্ষা বা দ্বন্দ্ব যখনই আসবে, তখনই উপনিষদের শিক্ষার আলোকে সমাধানের পথ খুঁজে বের করুন। মনে রাখবেন, দাম্পত্য জীবনে প্রেম ও শান্তি বজায় রাখার চাবিকাঠি হলো সৎভাব, শ্রদ্ধা, এবং ধ্যান।