আপনি কি কখনও ভেবেছেন, আমাদের প্রাচীন শাস্ত্র, বিশেষ করে উপনিষদ, দাম্পত্য জীবনে শান্তি বজায় রাখতে কতটা প্রাসঙ্গিক হতে পারে? আজ আমরা এই বিষয়ে গভীরে ডুব দেব।
উপনিষদের মূল শিক্ষা
উপনিষদ আমাদের শিখিয়েছে আত্মজ্ঞান, ধৈর্য এবং ভালোবাসার গুরুত্ব। দাম্পত্য জীবনে এগুলোর অভাবেই মূলত কলহের সৃষ্টি হয়। তাই যদি আমরা উপনিষদের বাণীগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করি, তাহলে বৈবাহিক জীবনে সমন্বয় আনা সম্ভব।
উপনিষদ বলে, “সত্যমেব জয়তে নানৃতম্।” (মুন্ডক উপনিষদ ৩.১.৬) অর্থাৎ, সত্যই চিরজয়ী। দাম্পত্য জীবনে সত্যের উপর ভিত্তি স্থাপন করলে, সম্পর্কের ভিত্তি শক্তিশালী হয়।
পারস্পরিক শ্রদ্ধা
বিবাহিত জীবনে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা অপরিহার্য। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে, “যঃ পশ্যতি সঃ পশ্যতি।” (যিনি সবার মধ্যে আত্মার উপস্থিতি অনুভব করেন, তিনিই সত্যদর্শী)। অর্থাৎ, আমাদের সঙ্গীর মধ্যে সেই চিরন্তন আত্মাকে অনুভব করতে হবে। সঙ্গীর মতামত, আবেগ, এবং প্রয়োজনকে যদি আমরা সম্মান করি, তাহলে কলহের সুযোগই কমে যাবে।
উদাহরণস্বরূপ, এক দম্পতি তাদের ছোটখাটো মতবিরোধ দূর করার জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যায় একসঙ্গে বসে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলেছিল। এই অভ্যাস তাদের সম্পর্ক মজবুত করতে সাহায্য করেছিল।
ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ
দাম্পত্য জীবনের বড় শত্রু হলো ক্রোধ। কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, “যঃ প্রাকযে ক্রোধং বিজয়তে তং বিজয়ং মুনি” (যিনি ক্রোধ জয় করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত জয়ী)। যখন আমরা ক্রুদ্ধ হই, তখন আমাদের মনোযোগ হারিয়ে ফেলি এবং অপ্রয়োজনীয় কথা বলে ফেলি।
উপনিষদ আমাদের ধ্যানের মাধ্যমে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেয়। মনে করুন, আপনার সঙ্গী কোনও ভুল করেছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে গভীর শ্বাস নিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করুন। দেখবেন, অনেক বড় সমস্যা সহজেই মিটে যায়।
অহংকার ত্যাগ
অহংকারই অধিকাংশ সমস্যার মূল। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, “অহংকারং পরিত্যজ্য, সর্বং সুখমাশ্নুতে।” (অহংকার ত্যাগ করলেই প্রকৃত সুখ লাভ হয়)।
এক দম্পতির গল্প মনে পড়ে। স্বামী ছিলেন একটু বেশি আত্মকেন্দ্রিক। স্ত্রী একদিন উপনিষদের এই উক্তিটি তাকে পড়তে দেন। ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন, সম্পর্কের মাধুর্য বজায় রাখতে অহংকার কমিয়ে আনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ফলস্বরূপ, তাদের সম্পর্ক আরও মধুর হয়ে ওঠে।
পরস্পর বোঝাপড়া
উপনিষদ বলে, “সাহ নৌ যজ্ঞঃ সহ নৌ ভুনক্তু।” অর্থাৎ, আমরা একে অপরকে বুঝি এবং একসঙ্গে উন্নতি করি। দাম্পত্য জীবনে বোঝাপড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
ধরুন, স্ত্রী চাকরি করতে চান, কিন্তু স্বামী চান তিনি ঘরে থাকুন। এ ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। নিজেদের ইচ্ছা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলুন। বোঝাপড়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব।
প্রেম ও ক্ষমা
প্রেম ও ক্ষমা দাম্পত্য জীবনের দুই স্তম্ভ। উপনিষদ বলে, “মৈত্রীং করুণা চ বোধাং” (মৈত্রী এবং করুণা জীবনের মঙ্গল আনে)। আমাদের সঙ্গীর প্রতি দয়া এবং মমতা দেখাতে হবে। ভুল করলে তাকে ক্ষমা করতে হবে।
একবার এক স্বামী তার স্ত্রীর উপর রেগে গিয়ে অপমানজনক কথা বলে ফেলেন। পরে তিনি ক্ষমা চান এবং স্ত্রীর প্রতি মমতা প্রদর্শন করেন। এই ছোট্ট ঘটনা তাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করে তোলে।
উপসংহার
উপনিষদের বাণী আমাদের দেখায়, কিভাবে আমরা দাম্পত্য জীবনে শান্তি ও সুখ আনতে পারি। আসুন, আমরা সত্য, ধৈর্য, এবং ভালোবাসার চর্চা করি।