দয়া ও করুণার ভূমিকা উপনিষদে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে?

দয়া ও করুণার ভূমিকা উপনিষদে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে?

আমাদের সনাতন ধর্মের প্রধান গ্রন্থ উপনিষদ, শুধুমাত্র জ্ঞান আর আত্মার সন্ধানের কথাই বলে না, বরং মানবিক গুণাবলির বিকাশের গুরুত্বও তুলে ধরে। এর মধ্যে দয়া ও করুণার আলোচনা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এই দুটি গুণ কেবল মানুষের মনকে শুদ্ধ করে না, বরং সমাজকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করে।

দয়া: জীবের প্রতি স্নেহের প্রকাশ

উপনিষদে দয়ার মূল ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে এই ভাবে যে, সব জীব সৃষ্টিকর্তার অংশ। বোধ নিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যায়, যেকোনো জীবের প্রতি দয়া দেখানো মানে সৃষ্টিকর্তার প্রতি সম্মান দেখানো। ইশোপনিষদে বলা হয়েছে:
“ঈশাবাস্যমিদং সর্বং, যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত।”
অর্থাৎ, এই সমগ্র বিশ্বে যা কিছু রয়েছে, তা ঈশ্বরের দ্বারা পরিপূর্ণ। সুতরাং জীবের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা মানে ঈশ্বরের সৃষ্টির অবমাননা করা।

একটা ঘটনা মনে পড়ে, মহাভারতের সময় কৃষ্ণ যখন শ্রীধামকে বোঝাচ্ছিলেন যে পশুপাখি, গাছপালা, এমনকি শত্রুর প্রতিও দয়া করা উচিত, তখন তিনি বলেছিলেন, “তুমি যদি একজনের দুঃখে করুণা দেখাও, তাহলে তুমি আমাকে সন্তুষ্ট করছ।”

করুণা: হৃদয়ের গভীর অনুভূতি

দয়া এবং করুণার মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। দয়া মানে অন্যের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন, আর করুণা মানে অন্যের দুঃখ কষ্ট গভীরভাবে উপলব্ধি করা এবং সেই কষ্ট দূর করার জন্য প্রেরণা পাওয়া। উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে,
“মা গৃহ্যকর্মী স্নেহম্, সর্বভূতেষু দয়া।”
যেখানে বলা হয়েছে, সব জীবের প্রতি করুণা প্রদর্শন করা একজন সত্যিকারের জ্ঞানীর ধর্ম।

পড়ো উপাখ্যান গৌতম বুদ্ধের জীবনের। যদিও তিনি ভিন্ন ধর্মে প্রবর্তিত হয়েছিলেন, তাঁর মূল শিক্ষা কিন্তু আমাদের উপনিষদেই নিহিত। একবার এক আহত পাখিকে তাঁর চেলা হত্যা করতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, “তোমার দয়া যদি এই পাখিটিকে রক্ষা না করতে পারে, তাহলে তোমার জ্ঞান মূল্যহীন।”

দয়া ও করুণা: আত্মজ্ঞানের পথপ্রদর্শক

উপনিষদে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে দয়া এবং করুণা শুধু সামাজিক গুণ নয়; এগুলি আত্মার বিকাশের জন্য অপরিহার্য। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে:
“সত্যমেব জয়তে, নানৃতম্।”
সত্যের সঙ্গে দয়া আর করুণা হাত ধরাধরি করে চলে। আত্মা যখন দয়ালু হয়, তখন সে সত্যের পথে চলতে শুরু করে।

একটা গল্প মনে আসে রামচন্দ্রের বনবাসের সময়ের। রাবণ যখন সীতাকে অপহরণ করল, তখন হনুমান শত্রুদের প্রতি করুণা দেখিয়েছিলেন। তিনি শুধুমাত্র সীতাকে উদ্ধার করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু কাউকে অযথা আঘাত করেননি। এমনকি লঙ্কাদাহের পরও তিনি অশ্রুস্বরে বলেছিলেন, “আমার আগুনে যদি কোনো নিরীহ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে আমি কখনো ক্ষমাপ্রার্থী হব।”

আমাদের জীবনে দয়া ও করুণার ব্যবহার

উপনিষদ আমাদের শিখিয়েছে যে দয়া আর করুণা কেবল একটি মানসিক গুণ নয়, বরং এগুলি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করার জন্য। আমাদের পরিবার, সমাজ, এবং পৃথিবীর প্রতিটি জীবের প্রতি এই গুণগুলো ব্যবহার করলে সত্যিকারের শান্তি সম্ভব।

যেমন ধরুন, আজকের সমাজে যদি আমরা প্রতিটি মানুষকে দয়া এবং করুণার সাথে গ্রহণ করি, তাহলে যুদ্ধ, হিংসা, এবং অশান্তি অনেকাংশেই কমে যাবে। উপনিষদে বলা আছে,
“যো হি সর্বাণি ভূতানি আত্মনেভানু পশ্যতি।”
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি সব জীবকে নিজের অন্তরের অংশ হিসেবে দেখে, তার মধ্যে কখনোই হিংসা বা ঘৃণা আসতে পারে না।

সনাতন শিক্ষার চিরন্তন আলো

দয়া ও করুণার শিক্ষাই আমাদের সনাতন ধর্মের মর্ম। এগুলি শুধু উপনিষদের শ্লোক নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের গাইডলাইন। আসুন, আমরা উপনিষদের এই মূল্যবান শিক্ষাগুলোকে নিজেদের জীবনে ধারণ করি এবং পৃথিবীকে আরও সুন্দর, শান্তিপূর্ণ করে তুলি।

“সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যেঁ শিবে সর্বার্থ সাধিকে।”
এ শিক্ষাই আমাদের পথের আলোকবর্তিকা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top