জীবন ও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তিগুলির মধ্যে একটি। এটি আমাদের জীবনযাত্রা এবং চিন্তাধারার এমন একটি অংশ যা প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে শিক্ষা দেয়। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টি সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র, বিশেষত উপনিষদে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
উপনিষদের মূল ভাবনা
উপনিষদ শব্দের অর্থ হলো “শিষ্যের সঙ্গে গুরু বসে যে জ্ঞান চর্চা করেন।” এই শাস্ত্রগুলোতে কেবল আধ্যাত্মিক উপলব্ধি নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের গভীর অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, সমস্ত জীব এবং প্রকৃতি এক অপরিহার্য সূত্রে বাঁধা।
“বসুধৈব কুটুম্বকম্” – একটি মহৎ বার্তা
উপনিষদে উল্লেখিত এই বাক্যটি আমাদের বলে যে, “পৃথিবীই আমার পরিবার।” এর অর্থ শুধু মানুষের পরিবার নয়, বরং গাছপালা, প্রাণী, নদী, পাহাড়, এবং প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানও আমাদের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। যদি প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তা আমাদেরও ক্ষতি করে।
জীবনের আন্তঃসম্পর্ক ও পরিবেশ রক্ষা
উপনিষদ বারবার বলে যে, ব্রহ্মাণ্ড একটি একক সত্তা। “ঈশা উপনিষদ” এই সত্যটি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরে:
“ঈশাবাস্যম্ ইদং সর্বং, যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত্।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা, মা গৃহঃ কস্যস্বিদ্ ধনম্।”
অর্থাৎ, সৃষ্টির সমস্ত কিছুই ঈশ্বরের আবাস। আমাদের প্রয়োজন অনুসারে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে, কিন্তু লোভ বা ক্ষতির জন্য কিছুই নিজের অধিকারে আনতে নিষেধ করা হয়েছে। এটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
গাছপালা এবং প্রাণীর প্রতি দায়িত্ব
উপনিষদে বিভিন্ন সময়ে গাছপালা এবং প্রাণীর সঙ্গে মানব জীবনের নিবিড় সংযোগের কথা বলা হয়েছে। “বৃহদারণ্যক উপনিষদ” এবং “ছান্দোগ্য উপনিষদ” বারবার বলেছেন যে, গাছও জীবিত সত্তা, এবং তাদেরও আত্মা আছে। এ কারণে গাছপালা কাটা, পশুহত্যা বা প্রকৃতি ধ্বংস করার আগে আমাদের চিন্তা করা উচিত।
আচার ও প্রথায় জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ
সনাতন ধর্মে এমন বহু প্রথা আছে যা প্রকৃতি রক্ষার শিক্ষা দেয়। উদাহরণস্বরূপ:
- পূজায় বেলগাছ, তুলসী, এবং পিপল গাছের ব্যবহার: এগুলি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে একটি প্রাচীন প্রথা।
- নদী এবং জলাশয় পবিত্র জ্ঞান: উপনিষদ নদীকে দেবী রূপে পূজা করতে বলেছেন, যা আমাদের জলের উৎস সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে।
- ব্রত ও উপবাস: প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অন্যতম উপায়।
আমরা কী করতে পারি?
আপনি যদি প্রকৃতিকে উপনিষদের নির্দেশনা অনুযায়ী সংরক্ষণ করতে চান, তবে ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে শুরু করতে পারেন:
- গাছ লাগান এবং তাদের রক্ষা করুন।
- প্রাণীদের প্রতি সদয় হন এবং তাদের খাদ্য ও আশ্রয় প্রদান করুন।
- প্রকৃতির সম্পদ অপচয় করবেন না।
- যত্রতত্র প্লাস্টিক ও বর্জ্য ফেলে প্রকৃতিকে দূষিত করবেন না।
শেষ কথা
উপনিষদে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ শুধু একটি তাত্ত্বিক বিষয় নয়, এটি একটি নৈতিক দায়িত্ব। যখন আমরা প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল হই, তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকর্তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি। তাই আসুন, আমরা উপনিষদের বার্তা মেনে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যকে ভালোবেসে তাদের রক্ষা করি।
“পরিবেশ রক্ষা করাই প্রকৃত ধর্ম পালন।”