আমাদের সনাতন ধর্ম সবসময় জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার শিক্ষা দেয়। আমরা সবাই জানি, মানুষ জীবনের লক্ষ্য খুঁজতে ব্যস্ত। ধনসম্পদ, খ্যাতি বা ভোগবিলাসের মধ্যে আমরা কি সত্যিই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য খুঁজে পাই? উপনিষদ আমাদের বলে, জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য হল মোক্ষ। মোক্ষ মানে মুক্তি—কেবল শরীর বা মন থেকে নয়, বরং এই জাগতিক বন্ধন থেকে।
চলুন, উপনিষদের আলোকে বুঝি জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য কীভাবে অর্জন করা যায়।
জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী হওয়া উচিত?
উপনিষদ বলে, আমাদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত পরমাত্মার সাথে একাত্মতা লাভ। এটি হল সেই স্তর, যেখানে ব্যক্তি আত্মা (জীবাত্মা) এবং পরমাত্মা (ব্রহ্ম) এক হয়ে যায়। “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—আমি ব্রহ্ম—এই উপলব্ধি আমাদের জীবনের আসল সাফল্য।
শরীরের চাহিদা পূরণ এবং মনকে শান্ত রাখা জীবনের অঙ্গ মাত্র, কিন্তু এগুলো চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। যতক্ষণ আমরা নিজেদের দেহ ও মনের সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকি, ততক্ষণ আমরা সত্যিকারের মুক্তি অর্জন করতে পারি না।
উপনিষদের গল্প থেকে শিক্ষা
উপনিষদের শিক্ষাগুলি গভীর এবং সহজ উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একটি বিখ্যাত গল্প হল “শ্বেতকেতু”-র।
শ্বেতকেতু ছিলেন এক জ্ঞানী ব্রাহ্মণ পুত্র। তিনি বহু শাস্ত্র অধ্যয়ন করেও বুঝতে পারছিলেন না জীবনের আসল উদ্দেশ্য কী। তার পিতা উদালক তাকে একটি গাছে ফলের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন—
“এই বীজটি ছোট, কিন্তু এর মধ্যেই পুরো বৃক্ষ লুকিয়ে আছে। ঠিক তেমনি, তোমার মধ্যেও ব্রহ্ম লুকিয়ে আছে। তাকে খুঁজে বের করতে হবে।”
এই গল্প থেকে আমরা শিখি, আমাদের নিজস্ব আত্মার মধ্যে পরমাত্মার উপস্থিতি বুঝতে পারাটাই জীবনের আসল লক্ষ্য।
মোক্ষ কীভাবে অর্জন করা যায়?
উপনিষদে মোক্ষ অর্জনের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পথ নির্দেশ করা হয়েছে।
- ধ্যান ও যোগ অভ্যাস
ধ্যান হল সেই মাধ্যম, যা আমাদের মনকে স্থির করে এবং আত্মার সাথে সংযোগ স্থাপন করে। “মুন্ডক উপনিষদ” বলে,
“যে নিজের আত্মাকে জানে, সে সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়।” - জ্ঞান অর্জন
উপনিষদের মতে, জ্ঞানই আমাদের অজ্ঞানতা দূর করতে পারে। এই জ্ঞান কোনও সাধারণ তথ্য নয়, বরং এটি হল নিজের আসল সত্ত্বাকে জানা। - নিঃস্বার্থ কর্ম
গীতার মতোই উপনিষদও বলে, নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে কিন্তু ফলাফলের আশা ছেড়ে। এই “নিষ্কাম কর্ম” আমাদের বন্ধনমুক্ত করে। - ভক্তি ও আত্মসমর্পণ
ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি এবং পরম শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ মোক্ষ লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
আমাদের সনাতন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি
আমরা যদি আমাদের শাস্ত্রগুলো খুঁটিয়ে দেখি, তবে বুঝতে পারি যে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য শুধুমাত্র বাহ্যিক সাফল্য নয়।
রামায়ণ আমাদের শিক্ষা দেয় কীভাবে ধর্ম এবং আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে জীবনকে সফল করা যায়। ভগবান রাম তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ধর্মের পথে। তিনি রাজা হয়ে সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু কখনো নিজেকে পার্থিব জিনিসের প্রতি আসক্ত হতে দেননি।
মহাভারতেও আমরা দেখতে পাই অর্জুন কীভাবে আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যমে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের বাণী অনুযায়ী,
“তোমার আত্মা হল তোমার আসল বন্ধু এবং শত্রু। নিজেকে জানলে তুমি মুক্ত হবে।”
আপনিও জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য খুঁজে পেতে পারেন
উপনিষদের শিক্ষা অনুসারে, আপনি যদি নিজের আত্মার প্রকৃতি বুঝতে পারেন, তবে আপনি জীবনের আসল লক্ষ্য খুঁজে পাবেন। এটা সহজ নয়, কিন্তু সম্ভব।
তাই চলুন, ধ্যান করি, জ্ঞান অর্জন করি এবং ভক্তির মাধ্যমে আমাদের আত্মাকে পরমাত্মার সাথে মিলিত করি। এটাই আমাদের সনাতন ধর্মের শিক্ষা। জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য শুধু আমাদের মুক্তি নয়, বরং এমন একটি অবস্থা, যেখানে আমরা ব্রহ্মান্ডের সাথে একাত্ম হয়ে যাই।
ধর্মমেধায়া সুখিনো ভবন্তু।
(ধর্মের পথে আমাদের সবার জীবনে শান্তি আসুক।)