ঋণগ্রস্ততা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় সম্পর্কে কিছু বলা হয়েছে কি?

ঋণগ্রস্ততা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় সম্পর্কে কিছু বলা হয়েছে কি?

আমাদের জীবনে ঋণগ্রস্ততার ধারণা অনেক গভীর। আমরা সাধারণত ঋণ শুনলেই মনে করি ব্যাংক বা বন্ধুর কাছ থেকে নেওয়া টাকা। কিন্তু ঋণ বলতে শুধু আর্থিক দায় নয়, এর গভীরে লুকিয়ে আছে আরও কিছু বড় সত্য। উপনিষদে বলা হয়েছে—জীবন নিজেই তিনটি প্রধান ঋণে আবদ্ধ: দেবঋণ, ঋষিঋণ এবং পিতৃঋণ। এগুলোর মধ্যে থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় খুঁজে পেলে, আমাদের মন ও জীবন প্রকৃত শান্তি খুঁজে পাবে।

তুমি কি জানো, এই ঋণ মুক্তির ধারণা উপনিষদের গভীর দার্শনিক শিক্ষা? আজ আমরা একসাথে খুঁজে বের করব কীভাবে এই ঋণ থেকে নিজেকে মুক্ত করা যায়।

১. ঋণগ্রস্ততার প্রকৃত অর্থ: উপনিষদের শিক্ষা

আমাদের জীবনে ঋণের সংজ্ঞা শুধুমাত্র অর্থে সীমাবদ্ধ নয়। “ঋণমুক্তি” বলতে বোঝায় প্রকৃতি, পূর্বপুরুষ, জ্ঞান এবং সমাজের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা পূরণ করা। ঔপনিষদিক জ্ঞান আমাদের শেখায় কীভাবে এসব ঋণ পরিশোধ করা যায়।

উপনিষদে বলা হয়েছে:
“ঋণাত্ অশ্বমেধযজ্ঞা ঋণে মুক্তি।”
(শতপথ ব্রাহ্মণ)
এর অর্থ, আত্মত্যাগ এবং কর্মের মাধ্যমে প্রকৃত ঋণমুক্তি সম্ভব।

তাহলে এই ঋণগুলো কী?

  • দেবঋণ: প্রকৃতি ও সৃষ্টির প্রতি আমাদের ঋণ। সূর্য, বায়ু, জল—এসবের কাছে আমরা ঋণী।
  • ঋষিঋণ: জ্ঞান ও শিক্ষকদের প্রতি আমাদের ঋণ। তাঁরা আমাদের চেতনাকে আলোকিত করেছেন।
  • পিতৃঋণ: আমাদের পূর্বপুরুষ, মা-বাবার ঋণ। তাদের মাধ্যমে আমরা জীবন পেয়েছি।

২. ঋণমুক্তির জন্য কর্ম: উদাহরণ ও উপায়

প্রাচীন ঋষিরা মনে করতেন, ঋণমুক্তি অর্জন করতে হলে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে।

ক) প্রকৃতির প্রতি ঋণ (দেবঋণ) পূরণ

আমরা প্রতিনিয়ত প্রকৃতির কাছ থেকে গ্রহণ করছি—অক্সিজেন, জল, আলো। কিন্তু কি দিচ্ছি আমরা? এক বৃক্ষরোপণের গল্প বলি।

একদিন এক ছাত্র গুরুগৃহে এসে বলল, “গুরুদেব, আমি জীবনে শান্তি পাচ্ছি না।”
গুরু বললেন, “তুমি কি একটি বৃক্ষ লাগিয়েছ? প্রকৃতির ঋণ শোধের চেষ্টা করেছ?”

ছাত্রটি মাথা নিচু করে বলল, “না।”
গুরু উত্তর দিলেন, “যেদিন তুমি প্রকৃতির সেবা করবে, সেদিন তোমার ঋণমুক্তি শুরু হবে।”

তাহলে আমরা কী করতে পারি?

  • বৃক্ষরোপণ করা।
  • জল সংরক্ষণ করা।
  • পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা।

উপনিষদে বলা হয়েছে:
“দ্বিজান্ন ঋণাঃ সমর্পণীয়ান্।”
(অর্থাৎ প্রকৃতির কাছে আমাদের দায়িত্ব অপরিসীম।)

খ) জ্ঞান ও শিক্ষকের প্রতি ঋণ (ঋষিঋণ)

জীবনে সত্যিকার জ্ঞানের আলো আমাদের দিশা দেখায়। শিক্ষক, গুরু এবং শাস্ত্রের কাছে আমরা ঋণী।

একটি গল্প মনে পড়ে—নচিকেতা এবং যমরাজের কথোপকথন। নচিকেতা যখন যমরাজের কাছে মৃত্যুর রহস্য জানতে গিয়েছিল, তখন যম তাকে বলেছিলেন—“সত্যের পথে যারা চলে, তাদের জ্ঞান দিয়ে মুক্তি।”

এখানে ঋষিঋণ শোধ করার উপায় কী?

  • শাস্ত্র পাঠ করা।
  • গুরুজনের সেবা করা।
  • প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করে অন্যকে শিক্ষা দেওয়া।

উপনিষদে বলা হয়েছে:
“সত্যমেব জয়তে, নানৃতম্।”
(সত্যই জয়ী হয়, মিথ্যা নয়।)

গ) পূর্বপুরুষদের ঋণ (পিতৃঋণ)

আমরা যে জীবন পেয়েছি, তার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে ঋণী।

একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে—এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে দুঃস্বপ্ন দেখছিল। সে গিয়ে এক সাধুর কাছে সাহায্য চাইল। সাধু বললেন, “তুমি কি তোমার পিতৃপুরুষদের স্মরণ করো?”

সে বলল, “না।”

সাধু উত্তর দিলেন, “তাদের স্মরণ করো, শ্রাদ্ধ ও ত্রিপিণ্ড প্রদান করো। তোমার দুঃস্বপ্ন দূর হবে।”

পিতৃঋণ শোধের জন্য আমাদের কী করা উচিত?

  • পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানানো।
  • মা-বাবার সেবা করা।
  • সমাজে ভালো কর্ম করে তাদের নাম উজ্জ্বল করা।

উপনিষদে বলা আছে:
“মাতৃ দেবো ভব, পিতৃ দেবো ভব।”
(মাকে ও বাবাকে দেবতার মতো সম্মান করো।)

৩. অর্থনৈতিক ঋণ থেকে মুক্তি: উপনিষদ কি বলে?

আজকের যুগে আর্থিক ঋণের বোঝা আমাদের জীবনে বিরাট সমস্যা তৈরি করেছে। কীভাবে মুক্তি পাব আমরা?

উপনিষদ বলে—“অপরিগ্রহ”, অর্থাৎ প্রয়োজনের বেশি ভোগ না করা।

কিছু উপায়:

  • অহেতুক ঋণ নেওয়া বন্ধ করা।
  • “যথা প্রয়োজন, ততটুকু গ্রহণ” করা।
  • সৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন ও ধৈর্যের সাথে ঋণ পরিশোধ করা।

একটি সুন্দর বাক্য আছে:
“যথার্থ কর্ম করো, ফলের আশায় নয়।”
(ভগবদ গীতা, ২.৪৭)

৪. আত্মিক মুক্তি: ঋণমুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়

সব ঋণ পরিশোধের পরও একটি বড় ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়া বাকি থাকে—নিজের আত্মার ঋণ।

উপনিষদ বলে:
“আত্মানং বিদ্ধি।”
(নিজের আত্মাকে জানো।)

কীভাবে তা সম্ভব?

  • ধ্যানের মাধ্যমে নিজের চেতনাকে জাগ্রত করা।
  • অহংকার পরিত্যাগ করে প্রকৃত আত্মজ্ঞান অর্জন করা।

ঋণমুক্ত জীবনের সত্য পথ

বন্ধুরা, ঋণমুক্তি মানে শুধুই দায়মুক্তি নয়, বরং তা প্রকৃত মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। উপনিষদের শিক্ষা আমাদের শিখিয়েছে যে প্রকৃতি, জ্ঞান এবং পূর্বপুরুষদের প্রতি দায়বদ্ধতা পূরণই আমাদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

আজ তুমি নিজেকে প্রশ্ন করো:
তোমার জীবনের ঋণগুলো কি তুমি শোধ করছো?

“ঋণ মুক্তির পথেই লুকিয়ে আছে পরম শান্তি।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top