উপনিষদ, আমাদের প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানধারা, শুধু আধ্যাত্মিক জগৎ নয়, দৈনন্দিন জীবনের জন্যও অমূল্য নির্দেশ দেয়। সন্তানের প্রতি পিতামাতার দায়িত্ব কীভাবে পালন করা উচিত, এ বিষয়ে উপনিষদে স্পষ্টভাবে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আসুন, আমি আপনাকে এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক ও উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করি।
পিতামাতার প্রধান দায়িত্ব: সন্তানের সুশিক্ষা
উপনিষদের মতে, পিতামাতার প্রধান কর্তব্য হলো সন্তানকে এমন শিক্ষা প্রদান করা যা তার জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে সাহায্য করে। “সা বিদ্যা বা মুক্তয়ে” (উপনিষদ) – বিদ্যা সেই যা মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এখানে মুক্তি মানে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক মুক্তি নয়, এটি জীবনের সমস্ত বাঁধা কাটিয়ে সত্যিকারের সুখ খুঁজে পাওয়ার শিক্ষাও।
উপনিষদের শিক্ষার আলোকে সন্তানের জীবন গঠন
আপনি যদি সন্তানের শৈশব থেকেই নৈতিক মূল্যবোধ ও সত্যের প্রতি নিষ্ঠার শিক্ষা দেন, তবে সে জীবনে সঠিক পথে চলতে পারবে। যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদে উল্লেখ আছে, “সত্যমেব জয়তে” – সত্যই সর্বদা জয়ী হয়। যদি আমরা সন্তানকে মিথ্যা ও প্রতারণা থেকে দূরে রাখি, তবে সে সমাজে সম্মানের স্থান পাবে।
সন্তানের মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশে পিতামাতার ভূমিকা
উপনিষদে বলা হয়েছে, শুধু বাহ্যিক শিক্ষায় সন্তানের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। তার মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশও সমান গুরুত্বপূর্ণ। “আত্মানং বিদ্ধি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ) – নিজের আত্মাকে জানো। আপনি যদি সন্তানকে তার ভেতরের শক্তি ও প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে সাহায্য করেন, তবে সে জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতেও দৃঢ় থাকতে পারবে।
ধ্যান ও আত্মোপলব্ধি শেখানো
আপনারা ধ্যানের অভ্যাস সন্তানকে শেখাতে পারেন। ধ্যান তাকে মানসিক শান্তি ও ধৈর্য প্রদান করবে। ক্ষুধিতর উপনিষদে উল্লেখ রয়েছে, “যো ভো গুরুঃ সঃ সুদুর্লভঃ” – যে প্রকৃত জ্ঞান দেয়, সেই গুরু বিরল। আপনি যদি পিতামাতা হিসেবে সন্তানের প্রথম গুরু হন, তবে তার আধ্যাত্মিক যাত্রা সঠিক পথে শুরু হবে।
নৈতিকতার শিক্ষা: উপনিষদের মন্ত্র অনুযায়ী জীবনযাপন
উপনিষদে পিতামাতার দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা যেন সন্তানকে দায়িত্বশীল ও ন্যায়পরায়ণ হতে শেখায়। “ধর্মং চ স্বাধ্যায়ান্ মা প্রমদঃ” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ) – ধর্ম পালন এবং শিক্ষায় কখনোই অবহেলা করো না। আপনি যদি সন্তানকে ছোট থেকেই ন্যায়পরায়ণতার গুরুত্ব বোঝাতে পারেন, তবে সে সঠিক পথে এগোবে।
ন্যায়পরায়ণতার উদাহরণ প্রদান
আপনার দৈনন্দিন জীবনে ন্যায় ও সততার চর্চা করলে সন্তান আপনাকে অনুকরণ করবে। সন্তান দেখবে কীভাবে আপনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ন্যায়বিচার বজায় রাখেন। এটি তাকে জীবনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি
ভালোবাসা এবং সহানুভূতির মাধ্যমে আপনি সন্তানকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারেন। উপনিষদে বলা হয়েছে, “মাতৃ দেবো ভব, পিতৃ দেবো ভব” – মা-বাবা সন্তানের কাছে ঈশ্বরতুল্য। আপনি যদি সন্তানকে ভালোবাসা ও সম্মানের সঙ্গে বড় করেন, তবে সে নিজের জীবনেও এটি অনুসরণ করবে।
কঠোরতা নয়, ভালোবাসার শিক্ষা দিন
আপনি যদি শুধুমাত্র কঠোর নিয়মকানুন চাপিয়ে দেন, তবে সন্তান আপনার থেকে দূরে সরে যেতে পারে। কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে তার ভুলগুলো সংশোধন করলে সে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে, “অহিংসা পরমো ধর্মঃ” – অহিংসা সর্বোচ্চ ধর্ম। সন্তানের সঙ্গে আপনার আচরণে এ শিক্ষা প্রতিফলিত হওয়া উচিত।
উপনিষদে পারিবারিক মূল্যবোধের গুরুত্ব
উপনিষদে পরিবারকে জীবনের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। একটি সুস্থ ও শক্তিশালী পরিবারই সন্তানের মানসিক ভিত্তি গড়ে তোলে। “সংঘাৎ শানাং কর্ম।” (ঋগ্বেদ) – সম্মিলিত প্রচেষ্টা সব কিছুকে সফল করে।
পরিবারের ঐক্য বজায় রাখা
আপনি যদি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখেন, তবে সন্তানও তা শিখবে। পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতা ও সম্মানের শিক্ষা তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কগুলিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
উপসংহার
উপনিষদে সন্তানের প্রতি পিতামাতার দায়িত্বকে ঈশ্বরীয় কর্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আপনি যদি উপনিষদের শিক্ষা অনুসরণ করে সন্তানকে বড় করেন, তবে সে শুধু আপনার নয়, পুরো সমাজের গর্ব হতে পারবে। শেষ কথা, আপনি কি প্রস্তুত আপনার সন্তানকে জীবনের সত্যিকারের পথ দেখানোর জন্য? উপনিষদ আপনাকে সেই দিশা দেখাবে। “অসতো মা সদগময়” – আমাদের মিথ্যা থেকে সত্যের দিকে নিয়ে চলুন।