আপনি কি কখনও ভেবেছেন, উপনিষদের মতো প্রাচীন গ্রন্থে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পারিবারিক কাঠামো নিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা আছে কি? আমরা অনেকেই জানি, উপনিষদ জীবনের গভীরতর দিক নিয়ে আলোচনা করে, কিন্তু পারিবারিক জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা কতখানি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলুন আমরা যৌথ পরিবার এবং একক পরিবারের আলোকে উপনিষদের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করি।
যৌথ পরিবার বনাম একক পরিবার: উপনিষদের শিক্ষা
আপনাদের মনে হতে পারে, উপনিষদে সরাসরি পরিবারের ধরন নিয়ে কিছু বলা হয়েছে কি? যদিও উপনিষদে সরাসরি “যৌথ পরিবার” বা “একক পরিবার” শব্দগুলির উল্লেখ নেই, কিন্তু এর গভীর বাণীগুলোতে আমরা এমন কিছু নির্দেশনা পাই যা পারিবারিক জীবনের ভিত্তি গড়তে সাহায্য করে।
উপনিষদ বলে:
“মাতৃ দেবো ভব, পিতৃ দেবো ভব, আচার্য দেবো ভব, অতিথি দেবো ভব।” – তৈত্তিরীয় উপনিষদ
এই মন্ত্রটি আমাদের শিখিয়েছে যে পরিবার শুধুমাত্র সম্পর্কের একটি কাঠামো নয়, এটি পূজনীয় এক আশ্রয়স্থল। এখানে মা, বাবা, গুরু এবং অতিথি – সকলেই দেবতুল্য। যৌথ পরিবারে এই মূল্যবোধগুলি সহজে রক্ষিত হয়, কারণ এখানে সম্পর্কের গভীরতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার চর্চা বেশি।
যৌথ পরিবারের উদাহরণ
আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে, যিনি যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। তার পরিবারে দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, এবং তাদের সন্তানরা সবাই মিলে একত্রে বসবাস করেন। প্রতিদিন সকালের প্রার্থনা এবং সন্ধ্যার আহার ছিল তাদের পরিবারে একটি ঐতিহ্য। ঈশোপনিষদ বলে:
“সর্বং কলো ইদং ব্রহ্ম।”
এই বাক্যটি মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি সম্পর্কের ভিতরে ঈশ্বরের উপস্থিতি আছে। যৌথ পরিবারে এর প্রকাশ স্পষ্ট, যেখানে সব বয়সের মানুষ একে অপরকে সম্মান করে এবং সাহায্য করে।
একক পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি
এখন কথা হলো, একক পরিবার কি উপনিষদের দৃষ্টিতে কোনোভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ? মোটেও নয়। বরং একক পরিবারে নির্দিষ্ট দায়িত্বের প্রতি মনোযোগ দেওয়া সহজ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন কর্মজীবী মা-বাবা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট সময় ও মনোযোগ দিতে পারে।
কঠোপনিষদ বলে:
“উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরণ নিবোধত।”
এই মন্ত্রটি আমাদের প্রেরণা দেয় জীবনে সঠিক পথে চলতে। একক পরিবারে স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীলতা শেখার সুযোগ বেশি থাকে, যা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
উপনিষদের শিক্ষা: একটি ভারসাম্য
আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, উপনিষদের শিক্ষা মূলত ভারসাম্যের উপর জোর দেয়? পরিবার বড় বা ছোট হোক, সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই আসল। উদাহরণস্বরূপ, যৌথ পরিবারে কখনও কখনও অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা মতবিরোধ দেখা যায়। অন্যদিকে, একক পরিবারে নিঃসঙ্গতা বা সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা হতে পারে।
মুণ্ডক উপনিষদ বলে:
“সত্যমেব জয়তে।”
পরিবারের মধ্যে সত্য এবং আন্তরিকতার চর্চা করলে, যে কোনো কাঠামোতেই সুখ এবং শান্তি বজায় রাখা সম্ভব।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ
- যৌথ পরিবারে একটি শিশুর বেড়ে ওঠা যেন একটি সমৃদ্ধ বাগানের মতো। শিশুটি তার দাদু-দাদীর কাছ থেকে গল্প শিখে, চাচা-চাচীর কাছ থেকে আদর পায়। ছান্দোগ্য উপনিষদ বলে:
“তন্ময় মনঃ।”
অর্থাৎ, মন যেন একাগ্র থাকে। যৌথ পরিবারের অভিজ্ঞতা শিশুর মানসিক বিকাশে এই একাগ্রতা তৈরি করে।
- একক পরিবারে মা-বাবার কাছে সন্তানই প্রধান। এটি শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। কঠোপনিষদ বলে:
“যঃ প্রণেহ যথা কম।”
যার অর্থ, মানুষকে তার প্রাপ্য ভালোবাসা দিতে হবে।
উপসংহার
আপনি কি কখনও ভেবেছেন, পরিবারের প্রকৃত কাঠামো নিয়ে উপনিষদ কী বলছে? আসলে, উপনিষদ আমাদের শিখিয়েছে, পরিবার বড় বা ছোট হোক, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং সত্যই হল তার ভিত্তি। আপনি যদি আপনার পরিবারে এই মূল্যবোধগুলি চর্চা করেন, তবে সেটি একটি উপনিষদীয় পরিবার হয়ে উঠবে।