উপনিষদ, সনাতন ধর্মের এক গভীরতম জ্ঞানভান্ডার, যেখানে প্রকৃতি, মানুষ এবং সৃষ্টির রহস্য নিয়ে অসংখ্য গভীর উপলব্ধি তুলে ধরা হয়েছে।
এখানে প্রকৃতি এবং মানুষের সম্পর্ককে শুধুমাত্র বাহ্যিক জগতের দৃষ্টিতে নয়, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতেও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই সম্পর্ক আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে।
আসুন, আমরা উপনিষদের আলোকে এই বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করি।
প্রকৃতি: ঈশ্বরের প্রকাশ
উপনিষদ বলে, প্রকৃতি ঈশ্বরের প্রকাশ। ঈশা উপনিষদে বলা হয়েছে:
“ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।”
অর্থাৎ, এই জগতের প্রতিটি বস্তুই ঈশ্বরের দ্বারা পরিবেষ্টিত। আপনি যে বৃক্ষ দেখছেন, নদীর স্রোত শুনছেন, কিংবা আকাশের নীলিমায় মুগ্ধ হচ্ছেন—এসবই সেই পরমাত্মার প্রকাশ।
এই উপলব্ধি আমাদের শিখিয়ে দেয় প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করতে, তার সঙ্গে একাত্ম হতে। প্রকৃতির প্রতিটি কণায় আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। তাই প্রকৃতিকে রক্ষা করা, তার প্রতি যত্নশীল হওয়া, এক প্রকার ধার্মিক দায়িত্ব।
মানুষ: প্রকৃতির সন্তান ও স্রষ্টা
মানুষ প্রকৃতির অংশ, আবার সে প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধও। উপনিষদে বলা হয়েছে যে, মানবজীবন শুধু ভোগের জন্য নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জীবনের লক্ষ্য অর্জন করার মাধ্যম।
ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে:
“তৎ ত্বমসি”
অর্থাৎ, “তুমিই সেই।” এই বাক্যের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, মানুষ এবং সমগ্র সৃষ্টি এক অভিন্ন চেতনার অংশ।
প্রকৃতি আমাদের জীবনধারণের জন্য যা কিছু দেয়:
- অন্ন,
- বায়ু,
- জল,
- আলো
তা কোনো ঋণ ছাড়া নয়। আমাদের এই ঋণ শোধ করতে হয় প্রকৃতির প্রতি সম্মান ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে।
পরস্পর নির্ভরশীলতা: ঋত ও ধর্ম
উপনিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো ঋত, যা প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে বোঝায়। ঋত মানে হলো বিশ্বজগতের শৃঙ্খলা। মানুষ যদি প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করে, তাহলে সেই শৃঙ্খলা নষ্ট হয় এবং তার পরিণতি মানুষকেই ভোগ করতে হয়।
উপনিষদ আমাদের শেখায় যে, প্রকৃতিকে শোষণ নয়, বরং সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এজন্যই বলা হয়েছে:
“মাতাভূমিঃ পুত্রোহং পৃথিব্যাঃ”
অর্থাৎ, “পৃথিবী আমাদের মা এবং আমরা তার সন্তান।”
প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কের আধুনিক শিক্ষা
আজকের দিনে, যখন পরিবেশ দূষণ, বনাঞ্চল ধ্বংস এবং জলবায়ুর পরিবর্তন মানবজাতিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তখন উপনিষদের এই চিরন্তন জ্ঞান আমাদের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
আমাদের মনে রাখা উচিত যে, প্রকৃতি শুধু ভোগের বস্তু নয়; এটি ঈশ্বরের দান। আপনি যদি প্রকৃতির প্রতি সদয় থাকেন, তবে প্রকৃতিও আপনাকে তার অমৃত দান করবে।
শেষ কথা
উপনিষদে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি আমাদের জানায়, প্রকৃতিকে রক্ষা করা মানে নিজেদের ভবিষ্যতকে রক্ষা করা। আপনারা যখন প্রকৃতির দিকে তাকাবেন, তখন তাকে কেবল একটি জড় বস্তু হিসাবে নয়, বরং ঈশ্বরের একটি জীবন্ত অভিব্যক্তি হিসাবে দেখুন।
আসুন, আমরা সবাই মিলে এই শিক্ষা গ্রহণ করি এবং প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে আরও গভীর ও অর্থবহ করি। কারণ, প্রকৃতি ও মানুষ একে অপরের পরিপূরক। এটি রক্ষা করা আমাদের জীবনের এক মহান ধর্ম।
“ওঁ শান্তি শান্তি শান্তিঃ”