উপনিষদে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব কীভাবে উল্লেখ করা হয়েছে?

উপনিষদে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব কীভাবে উল্লেখ করা হয়েছে?

আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, প্রাচীন শাস্ত্রগুলোতে পরিবেশের প্রতি এতটা গুরুত্ব কেন দেওয়া হয়েছে? উপনিষদ, যা সনাতন ধর্মের গভীরতম দার্শনিক ভিত্তি স্থাপন করে, সেখানে পরিবেশ রক্ষার বার্তাগুলো আমাদের কাছে আজও সমান প্রাসঙ্গিক। এই শাস্ত্রগুলো শুধু আত্মজ্ঞান বা ঈশ্বর চেতনার কথা বলে না, তারা আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথেও একাত্ম হওয়ার শিক্ষা দেয়।

উপনিষদের দর্শনে প্রকৃতি ও পরিবেশ

উপনিষদে প্রকৃতিকে কেবল জড় বস্তু নয়, বরং চেতনাসম্পন্ন ও পবিত্র বলে বিবেচনা করা হয়েছে। এখান থেকে আমরা শিখি, মানুষ ও প্রকৃতি একে অপরের উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, ঈশোপনিষদ আমাদের বলে:

“ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত।”
অর্থাৎ, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তুই ঈশ্বরের দ্বারা পরিব্যাপ্ত।

এই শ্লোকটি স্পষ্ট করে যে, আমরা প্রকৃতির যা কিছু দেখি, তা ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং তাই তা পবিত্র। এটি আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, প্রকৃতির সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলা আমাদের কর্তব্য।

পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ

উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদ অপচয় না করার কথা। প্রাচীন ঋষিরা জোর দিয়েছিলেন সংযমী জীবনযাপন ও ভারসাম্য রক্ষার উপর। উদাহরণস্বরূপ, ঋগ্বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রে বায়ু, জল, অগ্নি, পৃথিবী এবং আকাশকে দেবতা হিসেবে পূজা করার প্রচলন ছিল। এতে মানুষের মনে পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হতো।

ঈশোপনিষদ আরও বলে:

“তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম।”
অর্থাৎ, আমাদের যা প্রয়োজন তা নাও, কিন্তু লোভ করো না।

এটি শুধুমাত্র একটি নৈতিক উপদেশ নয়, বরং পরিবেশের প্রতি একটি গভীর প্রতিশ্রুতির প্রতীক। অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ করলে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারায়, যার ফল আজকের পরিবেশ সংকট।

গাছপালা ও জল সংরক্ষণের শিক্ষা

উপনিষদ ও অন্যান্য বৈদিক গ্রন্থে বৃক্ষরোপণ এবং জল সংরক্ষণের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। ঋষিরা গাছকে ‘বনদেবতা’ এবং নদীকে ‘মাতৃরূপা’ বলে অভিহিত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ:

  • অথর্ববেদ নদী ও জলকে জীবনের উৎস হিসেবে শ্রদ্ধা করতে বলে।
  • যজুর্বেদ গাছকে জীবনীশক্তির প্রতীক বলে বর্ণনা করে।

যখন আপনি গাছের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন বা নদীকে পবিত্র মনে করেন, তখন আপনি তাদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি নেন। এই শিক্ষা আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের মূল ভিত্তি হতে পারে।

আধুনিক যুগে উপনিষদের প্রাসঙ্গিকতা

আজকের দিনে আমরা যেভাবে প্রকৃতিকে শোষণ করছি, তা কি উপনিষদের শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? অবশ্যই নয়। প্লাস্টিক দূষণ, বায়ুদূষণ, জল সংকট – এগুলো আমাদের অপব্যবহারের ফল। উপনিষদ আমাদের শেখায়, প্রকৃতি আমাদের জন্য নয়, আমরা প্রকৃতির অংশ। তাই পরিবেশ রক্ষায় কাজ করাটা শুধু আমাদের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের ধর্ম।

আপনারা যদি উপনিষদের আদর্শকে অনুসরণ করেন, তবে নিশ্চিতভাবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে পরিবেশ রক্ষার প্রচেষ্টা আরও ফলপ্রসূ হবে।

উপনিষদের পরিবেশ রক্ষার বার্তাগুলো কেবল ধর্মীয় চেতনার অংশ নয়, এটি জীবনের সার্বিক ভারসাম্য রক্ষার নির্দেশিকা। আসুন, আমরা সবাই মিলে প্রকৃতিকে তার প্রাপ্য সম্মান দিই এবং পরিবেশ রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হই।

ঈশ্বরের সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করাই প্রকৃত ধর্ম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top